জোহানেসবার্গে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন: মার্কিন বয়কটের মাঝে ১২২ দফা ঘোষণাপত্র গৃহীত

২০২৫ সালের ২২ থেকে ২৩ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হলো ‘গোষ্ঠী বিশ’ বা জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। এটি ছিল আফ্রিকান মহাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের প্রথম বৈঠক। দক্ষিণ আফ্রিকার সভাপতিত্বে এই সম্মেলনের মূল ভাবনা ছিল ‘সংহতি, সমতা ও স্থিতিশীলতা’। তবে এই আয়োজন এক অভূতপূর্ব ঘটনা দ্বারা কলঙ্কিত হয়—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে সম্মেলনটি বর্জন করে। এই অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।

আমেরিকান প্রতিনিধিদল অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও, সম্মেলনে উপস্থিত দেশগুলোর নেতারা অভূতপূর্ব ঐক্য প্রদর্শন করেন। তারা শনিবার, ২২ নভেম্বর, মাত্র একদিনের মধ্যেই ১২২ দফা সমন্বিত চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রটি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেন। সাধারণত এই ধরনের চূড়ান্ত নথি সম্মেলনের শেষ দিনে অনুমোদিত হওয়ার রীতি ছিল, কিন্তু এবার সেই প্রথা থেকে সরে আসা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা দৃঢ়তার সঙ্গে জানান যে আমেরিকার এই অনুপস্থিতি তাদের নিজস্ব ক্ষতি, কারণ তারা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। তিনি আরও বলেন যে এই বয়কট মূল আলোচনাগুলোর অগ্রগতি থামাতে পারবে না। কূটনৈতিক এই বিভাজন আরও তীব্র হয় যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এজেন্ডা এবং সম্পত্তি ‘ব্যাপকভাবে বাজেয়াপ্তকরণ’ ও ‘অবৈধ দখলের’ বিষয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছিল, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার জি২০ সদস্যপদ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।

রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন রাষ্ট্রপতির প্রশাসন উপ-প্রধান ম্যাকসিম ওরেস্কিন, কারণ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিন উপস্থিত থাকতে পারেননি। জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ বৈঠকে মার্কিন সরকারের অনুপস্থিতির সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। গৃহীত ঘোষণাপত্রটি মূলত গ্লোবাল সাউথের অগ্রাধিকারগুলোকে প্রতিফলিত করে, যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, ঋণের স্থিতিশীলতা এবং ন্যায্য শক্তি রূপান্তরের মতো বিষয়গুলো বিশেষভাবে স্থান পায়। ১৭টি অধ্যায় সংবলিত এই নথিতে আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি২০-এর পূর্ণ সদস্য হিসেবে স্বাগত জানানো হয়, যা বিশ্ব পরিচালনায় আফ্রিকার বৃহত্তর ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে যদি বৃহৎ আন্তর্জাতিক সংকটগুলো নিরসনে দেশগুলো ব্যর্থ হয়, তবে জি২০ তার ‘চক্রের শেষ প্রান্তে’ পৌঁছে যেতে পারে। সম্মেলনের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট রামাফোসার সঙ্গে আলোচনা করেন, যেখানে বিনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ নিয়ে আলোকপাত করা হয়। ২৫শে মার্চে সমাপ্ত আর্থিক বছরে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল। মোদি এরপর আইবিএসএ (ভারত-ব্রাজিল-দক্ষিণ আফ্রিকা) নেতাদের বৈঠকে যোগ দেন, যেখানে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মডেলে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়।

রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান ম্যাকসিম ওরেস্কিন বিশ্ব অর্থনীতিতে একতরফা পদক্ষেপ, যেমন নিষেধাজ্ঞা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট বিভাজন বা খণ্ড খণ্ড হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। তবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি আশ্বস্ত করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়াই বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকার জি২০ সভাপতিত্ব ৩০শে নভেম্বর, ২০২৫-এ শেষ হয়, এবং এর দায়িত্ব পরবর্তী বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরিত হয়, যারা ২০২৬ সালে ফ্লোরিডায় সম্মেলন আয়োজন করবে। জোহানেসবার্গ সম্মেলন জি২০-এর মনোযোগকে আফ্রিকা এবং গ্লোবাল সাউথের সমস্যাগুলোর দিকে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার রেখে গেল, যা দক্ষিণ আফ্রিকার সভাপতিত্বের মূল অর্জন।