আফ্রিকার মাটিতে জি২০-এর ঐতিহাসিক প্রথম সম্মেলন: বিতর্ক ও খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর, দুই দিনব্যাপী ‘বিগ টুয়েন্টি’ (G20) শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে, যা আফ্রিকান মহাদেশে এই ধরনের আয়োজনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। দক্ষিণ আফ্রিকার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনটি ‘সংহতি, সমতা, স্থিতিশীলতা’—এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে আয়োজিত হয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিচালনায় আফ্রিকা এবং গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে সুসংহত করা। এই ঐতিহাসিক পটভূমি তৈরি হয় ২০২৩ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নকে G20-এর পূর্ণ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পর।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা সম্মেলনের সূচনা করে বিশ্বব্যাপী সমস্যা মোকাবিলায় বহুপাক্ষিকতার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সভাপতিত্বকাল ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কার্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণভার লাঘব করা এবং ন্যায্য শক্তি রূপান্তর নিশ্চিত করা। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে জলবায়ু অর্থায়ন সংগ্রহ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই সম্মেলনটি দক্ষিণ আফ্রিকার সভাপতিত্বকালে আয়োজিত প্রায় ১৩০টি বৈঠকের চূড়ান্ত পরিণতি। উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় ৮৫ শতাংশই G20 সদস্যভুক্ত দেশগুলোর দখলে।

ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার আবহে এই সম্মেলনটি কিছু বর্জনের সাক্ষী ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘন এবং ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইনের ওপর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সভাপতিত্বের অগ্রাধিকারের সঙ্গে মতানৈক্য পোষণ করে সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। আর্জেন্টিনা রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়ে শীর্ষ বৈঠকটি বয়কট করে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পরিবর্তে স্টেট কাউন্সিলের প্রিমিয়ার লি কিয়াং উপস্থিত ছিলেন, আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনুপস্থিত থাকায় দেশটির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন উপ-রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপ-প্রধান ম্যাক্সিম ওরেস্কিন।

কয়েকটি বৃহৎ অর্থনীতির রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও, শনিবার, ২২ নভেম্বর, ‘নেতৃবৃন্দের ঘোষণা’ গৃহীত হয়। প্রেসিডেন্ট রামাফোসা এটিকে বহুপাক্ষিকতার সাফল্যের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন, যা প্রমাণ করে যে ‘বহুপাক্ষিকতা ফল দিতে পারে এবং দেয়’। সম্মেলনের ঠিক আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়—ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে সমালোচনামূলক খনিজ পদার্থ, যেমন সেগুলোর অনুসন্ধান, উত্তোলন, প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনর্ব্যবহার সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন মন্তব্য করেন যে, ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকার পরিচ্ছন্ন শক্তি রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং ইইউ-এর সরবরাহ শৃঙ্খল বৈচিত্র্যময় করতে এই চুক্তি অপরিহার্য।

বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান ঋণভার, যা বর্তমানে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে (যার বার্ষিক সুদ পরিশোধ প্রায় ৮৯-৯০ বিলিয়ন ডলার), তা আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এই প্রসঙ্গে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে ঋণগ্রহীতাদের জন্য একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইন ও আন্তোনিও কোস্টা উপস্থিত ছিলেন। আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জোয়াও লরেনসোও এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন।

এই সম্মেলন ২৩ নভেম্বর সমাপ্ত হবে। এরপর G20-এর সভাপতিত্বের দায়িত্ব হস্তান্তরিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। তারা ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে মায়ামিতে পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবে।