ব্রুসেলস, বেলজিয়াম, ইইউ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রুশ গ্যাস বর্জন: ইউরোপ ও বিশ্বের জন্য এর তাৎপর্য কী?
সম্পাদনা করেছেন: an_lymons
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরতা কমানোর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই সিদ্ধান্ত আগামী বছরগুলোর জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিচ্ছে—২০২৬ থেকে ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রুশ এলএনজি (LNG) এবং পাইপলাইনের গ্যাসের সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ইউরোপের জ্বালানি ভূ-রাজনীতিতে এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে।
এই রূপান্তর প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হবে, তা নতুন বিধিমালায় ধাপে ধাপে সাজানো হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে, সমাপ্তির সময়সীমা আরও কঠোরভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিগুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি মসৃণ পথ রাখা হয়েছে, যেখানে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করা হবে। তবে, কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে সাধারণ নিয়ম থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।
এই বিধিমালাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জরুরি অবস্থার জন্য নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার প্রক্রিয়া। যদি গ্যাস সরবরাহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় অথবা ভূগর্ভস্থ গ্যাস মজুত পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকে, তবে এই ব্যবস্থা সক্রিয় করা যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ নেই, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা অতিরিক্ত সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
জাতীয় পর্যায়ে বৈচিত্র্যায়নের পরিকল্পনা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা কীভাবে রুশ গ্যাস ও তেল প্রতিস্থাপন করবে, তা উল্লেখ থাকবে। এই নথিতে বিকল্প উৎসের দিকে স্থানান্তরের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, বাস্তবসম্মত সময়সীমা এবং সরবরাহকারী পরিবর্তনের সময় ঝুঁকি কমানোর কৌশল স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। এটি প্রতিটি দেশের নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
ইইউ-এর অভ্যন্তরে মতভেদ
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইইউ-এর ভেতরে মতভেদ রয়েছে। যারা এই পদক্ষেপের সমর্থক, তারা এটিকে জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করার এবং রাশিয়ার দিকে আর্থিক প্রবাহ কমানোর একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। সমালোচকরা অবশ্য মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার অবনতির বিষয়ে সতর্ক করছেন, যদিও তারা বিধিমালায় থাকা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলোর গুরুত্ব স্বীকার করেন।
বিকল্প উৎস: ইউরোপ কোথায় প্রতিস্থাপন খুঁজছে?
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ইইউ বৈচিত্র্যায়নের জন্য একাধিক দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কাতারের কাছ থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। স্পেন, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডসের টার্মিনালগুলোর মাধ্যমে এই সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২৪ সালে ইউরোপীয় আমদানিতে আমেরিকান এলএনজি-এর অংশ ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
দ্বিতীয়ত, উত্তর আফ্রিকার পাইপলাইন গ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প। আলজেরিয়া ইতিমধ্যেই মেডগাজ (Medgaz) এবং ট্রান্সমেড (TransMed) পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে এবং অবকাঠামো সম্প্রসারণের আলোচনা চলছে। তৃতীয়ত, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে। সৌর এবং বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হচ্ছে; ২০৩০ সালের মধ্যে ইইউ তার মোট জ্বালানি মিশ্রণে নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ ৪২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। চতুর্থত, হাইড্রোজেনকে গ্যাসের দীর্ঘমেয়াদী বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ইইউ অভ্যন্তরীণভাবে ১০ মিলিয়ন টন 'সবুজ' হাইড্রোজেন উৎপাদন এবং আরও ১০ মিলিয়ন টন আমদানি করার পরিকল্পনা করছে।
রাশিয়ার কৌশল: নতুন পথ ও অংশীদার
অন্যদিকে, রাশিয়াও তার রপ্তানি প্রবাহকে সক্রিয়ভাবে পুনর্বিন্যাস করছে। এশিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে; 'পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া' (Power of Siberia) গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে 'পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া – ২' পাইপলাইনের নকশা তৈরি চলছে। দক্ষিণে, তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা জোরদার করা হচ্ছে। এছাড়াও, ইয়ামাল এবং মুরমানস্ক অঞ্চলে গ্যাস তরলীকরণ (LNG) প্রকল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের পুনর্গঠনের একটি অংশ, যেখানে ভৌগোলিক নৈকট্য আর মূল চালিকাশক্তি থাকছে না।
বিশ্ব জ্বালানি বাজারের জন্য এর অর্থ কী?
ইইউ-এর এই সিদ্ধান্ত রুশ গ্যাসের ওপর উচ্চ নির্ভরতার যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং একটি নতুন বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে। এর ফলে সরবরাহ বৈচিত্র্যকরণ এখন জ্বালানি নীতির প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু-মুখী অংশীদারিত্ব একক সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীলতাকে প্রতিস্থাপন করছে। প্রযুক্তিগত রূপান্তর কার্বন নিঃসরণ কম এমন অর্থনীতির দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে সাহায্য করছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)-এর অনুমান অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় আমদানিতে রুশ গ্যাসের অংশ ২০২১ সালের ৪০ শতাংশের তুলনায় কমে ৫ থেকে ১০ শতাংশে নেমে আসতে পারে। একই সাথে, জ্বালানি দক্ষতা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির কারণে ইইউ-এর মোট গ্যাসের চাহিদা ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।
একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, ২০২৩ সালে নরওয়ে ইউরোপের বৃহত্তম গ্যাস সরবরাহকারী হিসেবে রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। উন্নত পাইপলাইন অবকাঠামো এবং স্থিতিশীল উৎপাদন ভলিউমের কারণে নরওয়ের অংশ ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেছে।
অতএব, ইউরোপের নতুন জ্বালানি পথে যাত্রা কেবল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি জটিল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, যার জন্য বাজারের সকল অংশীদারের কাছ থেকে সমন্বয়, বিনিয়োগ এবং নমনীয়তা প্রয়োজন।
উৎসসমূহ
NaturalNews.com
Juno News
ceenergynews
European Interest
Clean Energy Wire
এই বিষয়ে আরও খবর পড়ুন:
আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?
আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।
