বিশ্বজুড়ে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য একটি যুগান্তকারী চুক্তি, যা 'হাই সিজ ট্রিটি' নামে পরিচিত, তা ২০২৫ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হতে চলেছে। মরক্কোর অনুসমর্থনের পর, ৬০টিরও বেশি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যা আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবস্থিত মহাসাগরের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অংশকে সুরক্ষিত করার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই চুক্তিটি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গভীর সমুদ্র খননের মতো হুমকি থেকে রক্ষা করার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
প্রায় দুই দশকের আলোচনা ও প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ গৃহীত এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামুদ্রিক জীবনের সুরক্ষার জন্য প্রথম আইনত বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি। এর মাধ্যমে দেশগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল (MPA) প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং পরিকল্পিত মানব কার্যক্রমের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে পারবে। এছাড়াও, এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জ্ঞান ও প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে, সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সামুদ্রিক জিনগত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে তাদের সুবিধা প্রদান করবে।
এই বিধানগুলো জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০% স্থল ও সমুদ্রকে সুরক্ষিত করার 'কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক' (GBF) এর ৩০x৩০ লক্ষ্যমাত্রাও অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মহাসাগর নিয়ে গঠিত এই হাই সিজ বা উন্মুক্ত সমুদ্র অঞ্চল পৃথিবীর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি তাপ ও কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অর্ধেক উৎপাদন করে। কিন্তু এই অঞ্চলটি অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গভীর সমুদ্র খনিজ উত্তোলনের মতো হুমকির সম্মুখীন।
এই চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে কিছু উদ্বেগও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং জাপানের মতো প্রধান দেশগুলোর পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ বা অনুসমর্থনের অভাব চুক্তির কার্যকারিতা দুর্বল করতে পারে। যদিও অনেক দেশ স্বাক্ষর করেছে, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ৬০টি দেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে, যা ৬০টির প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অনেক কম। এই কম অনুসমর্থনের একটি কারণ হলো সামুদ্রিক বিতর্কিত স্থানগুলির অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব, যেমন দক্ষিণ চীন সাগর।
সমুদ্রের যা কিছু ঘটে, তা আমাদেরও প্রভাবিত করে। এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্টেশন, চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। যদি আমরা সমুদ্রকে আবর্জনার স্তূপ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি, তবে সবচেয়ে বড় বিপদ এখনও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এই চুক্তিটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির জন্য একটি বড় পদক্ষেপ, যা দীর্ঘকাল ধরে তাদের নাগালের বাইরে থাকা সিদ্ধান্তগুলিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ করে দেবে। এই চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, আঞ্চলিক সক্ষমতা এবং আন্তঃবিভাগীয় পদ্ধতির অভাবের মতো চ্যালেঞ্জগুলিও বিদ্যমান।
তবে, এই চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী সমুদ্র শাসনের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমুদ্রকে সুস্থ ও স্থিতিশীল রাখার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। এই চুক্তিটি কেবল সমুদ্রের জন্য একটি বিজয় নয়, এটি আমাদের গ্রহ এবং এর উপর নির্ভরশীল সকলের জন্য একটি বিজয়।