ফ্রান্স এক গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বায়রুর (François Bayrou) সরকার ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে একটি অনাস্থা ভোটে পরাজিত হওয়ার পর ভেঙে পড়েছে। এই পতন দেশটির আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিবাদে, বিশেষ করে দুটি সরকারি ছুটির দিন বাতিলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে, 'ব্লকোটু' (Bloquons tout) আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
বায়রুর সরকার, যা মাত্র নয় মাস আগে ক্ষমতায় এসেছিল, জাতীয় ঋণ কমাতে একটি কঠোর ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছিল। এই নীতির অংশ হিসেবে, ইস্টার সোমবার এবং ৮ মে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের স্মারক দিবস) সরকারি ছুটি বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই পদক্ষেপগুলি জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ব্লকোটু' আন্দোলনের জন্ম দেয়। এই আন্দোলনটি দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং সড়ক অবরোধের ডাক দেয়।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে প্যারিস সহ ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। প্যারিসে, বিক্ষোভকারীরা শহর প্রদক্ষিণকারী রাস্তা (périphérique) অবরোধের চেষ্টা করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশকে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করতে হয় এবং সকাল ৮টার মধ্যে প্যারিসে ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই বিক্ষোভে প্রায় ৬,০০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। দেশের অন্যত্রও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রিটেলো (Bruno Retailleau) এই সহিংসতাকে 'চরমপন্থী বামপন্থী' গোষ্ঠীর দ্বারা আন্দোলনকে হাইজ্যাক করার প্রচেষ্টা বলে নিন্দা করেছেন।
এই রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে, রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron) ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু (Sébastien Lecornu)-কে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছেন। ৩৯ বছর বয়সী লেকোর্নু ম্যাক্রোঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পূর্বে 'ইয়েলো ভেস্ট' (Yellow Vests) আন্দোলনের সময়কার সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা এবং রাজনৈতিক বিভাজন লেকোর্নুর সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, লেকোর্নুর নিয়োগ ম্যাক্রোঁর ব্যবসায়-বান্ধব অর্থনৈতিক নীতি অব্যাহত রাখার ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে, কিন্তু এটি বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ বাড়াতে পারে। এই ঘটনাগুলি কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, বরং ফ্রান্সের সমাজের গভীরে থাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সরকারি নীতির প্রতি অসন্তোষকেও তুলে ধরেছে। এটি একটি সুযোগ যা জনগণের চাহিদা এবং সরকারের নীতিগুলির মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্য খুঁজে বের করার পথ খুলে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতিটি 'ইয়েলো ভেস্ট' আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল। 'ব্লকোটু' আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগঠিত হলেও, এর প্রভাব ব্যাপক এবং এটি ফ্রান্সের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর প্রশ্ন তুলেছে। দেশব্যাপী ৮০,০০০ পুলিশ মোতায়েন করা সত্ত্বেও, বিক্ষোভকারীরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এই ঘটনাগুলি ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।