নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে সংগঠিত গণ-আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলির পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এই প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারের আকস্মিক সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণকে কেন্দ্র করে, যা দ্রুত দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষে রূপ নেয়। ঘটনার সূত্রপাত হয় সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে, যখন নেপাল সরকার ২৬টি প্রধান সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করে। সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধন সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ভুয়া খবরের মতো বিষয়গুলির উল্লেখ করা হলেও, তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেনারেশন জেড (Gen Z), এটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখে।
এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত সহিংস রূপ ধারণ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং শত শত মানুষ আহত হয়। এই সহিংসতা দেশজুড়ে কারফিউ জারি এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা পর্যন্ত গড়ায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে এবং জনরোষের মুখে, প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন। একই সাথে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখাও এই ঘটনার নৈতিক দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন।
এই প্রতিবাদের মূল কারণ হিসেবে সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি দেশের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং উচ্চ বেকারত্বকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে নেপালে তরুণদের বেকারত্বের হার ২২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং দেশের ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এই আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা তরুণ প্রজন্মকে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারা পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নামে।
এই আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উঠে এসেছেন কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ। একজন প্রাক্তন র্যাপার এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচিত শাহ, যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়, তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং সংযম পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উত্থান নেপালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ঘটনাপ্রবাহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। জাতিসংঘ ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত এবং শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলিও নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিক্ষোভকারীরা কেবল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগই নয়, বরং সংবিধানের সংস্কার, নতুন নির্বাচন এবং দীর্ঘ তিন দশক ধরে চলা দুর্নীতির তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে। এই আন্দোলন নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে তারা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার এবং ঐক্যবদ্ধ। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, যখন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অবহেলিত হয়, তখন সম্মিলিত কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে।