মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে মানবজাতির দীর্ঘদিনের আগ্রহকে নতুন মাত্রা দিতে চলেছে ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ। নাসা-র প্রথম চিফ অ্যাস্ট্রোনমার ন্যান্সি গ্রেস রোমান-এর নামে নামকরণ করা এই অত্যাধুনিক মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এর উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন জরিপ এবং এক্সোপ্ল্যানেট (পৃথিবীর বাইরের গ্রহ) অনুসন্ধানের ক্ষমতা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। রোমান স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের বিশাল অঞ্চল জুড়ে ক্ষণস্থায়ী ঘটনা, যেমন সুপারনোভা এবং নিউট্রন তারার সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এর প্রশস্ত ক্ষেত্র (wide field of view) এবং উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অভূতপূর্ব বিশদে মহাকাশের বৃহৎ অংশ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। বর্তমানে, টেলিস্কোপটি সিস্টেম অ্যাসেম্বলি, ইন্টিগ্রেশন এবং টেস্ট (System Assembly, Integration, and Test) পর্যায়ে রয়েছে এবং ২০২৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৭ সালের মে মাসের মধ্যে এটি উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
রোমান মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হাই-লেটিটিউড টাইম-ডোমেন সার্ভে (High-Latitude Time-Domain Survey)। এই জরিপের মাধ্যমে মহাকাশের একই অঞ্চলগুলি প্রায় পাঁচ দিন অন্তর দুই বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এর ফলে মহাবিশ্বের একটি গতিশীল চিত্র পাওয়া যাবে, যা টাইপ Ia সুপারনোভা এবং কাইলোনোভা (kilonova) বিস্ফোরণের মতো ক্ষণস্থায়ী ঘটনাগুলি উন্মোচন করবে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাগুলি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ইতিহাস এবং ডার্ক এনার্জির (অন্ধকার শক্তি) প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করবেন। এই টেলিস্কোপটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার পরিমাপ করতে টাইপ Ia সুপারনোভা ব্যবহার করবে, যা মহাজাগতিক ত্বরণে ডার্ক এনার্জির ভূমিকা বুঝতে সহায়ক হবে। এছাড়াও, গ্র্যাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিং (gravitational microlensing) কৌশল ব্যবহার করে এটি বাসযোগ্য অঞ্চলে (habitable zones) থাকা এক্সোপ্ল্যানেটগুলি সনাক্ত ও অধ্যয়ন করবে, যা আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহমণ্ডল সম্পর্কে জ্ঞানকে প্রসারিত করবে। রোমান টেলিস্কোপের প্রশস্ত-ক্ষেত্র ইমেজিং গ্যালাক্সির বিন্যাস এবং বৃহৎ-মাপের কাঠামো ম্যাপ করবে, যা মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে। নাসা-র ভাষ্যমতে, রোমান টেলিস্কোপ হাবল স্পেস টেলিস্কোপের চেয়ে অন্তত ১০০ গুণ বড় ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে এবং এটি প্রায় এক বিলিয়ন গ্যালাক্সির আলো পরিমাপ করতে পারবে। এটি মহাকাশে প্রথম উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন করোনারগ্রাফ (coronagraph) যন্ত্র বহন করবে, যা সরাসরি এক্সোপ্ল্যানেটগুলি চিত্রিত করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের মিশনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ২০৪০-এর দশকে জীবনের সন্ধানকারী মিশনের পথ প্রশস্ত করবে। রোমান স্পেস টেলিস্কোপ প্রায় ১০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে, রোমান স্পেস টেলিস্কোপের অ্যাসেম্বলি এবং ইন্টিগ্রেশন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে অপটিক্যাল টেলিস্কোপ অ্যাসেম্বলি (Optical Telescope Assembly) নাসা-র গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে (Goddard Space Flight Center) পৌঁছেছে, যা মিশনটিকে নির্ধারিত উৎক্ষেপণের সময়সূচীর মধ্যে রেখেছে। ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের গতিশীলতা বোঝার ক্ষেত্রে একটি বিশাল অগ্রগতি নির্দেশ করে। এর ব্যাপক জরিপ এবং উন্নত যন্ত্রগুলি ডার্ক এনার্জি থেকে শুরু করে দূরবর্তী এক্সোপ্ল্যানেট পর্যন্ত মহাজাগতিক ঘটনাগুলি সম্পর্কে অভূতপূর্ব অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে। ২০২৬ সালের উৎক্ষেপণের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে, বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় রোমান থেকে প্রত্যাশিত উল্লেখযোগ্য জ্ঞান অর্জনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।