গ্রেট ব্রিটেনের রাজতন্ত্র অক্টোবর ২০২৫ সালে ডিউক অফ ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ড্রুর অবশিষ্ট সমস্ত রাজকীয় উপাধি এবং সম্মান আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে এক নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রাজপরিবারের ইতিহাসে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত খুব কমই দেখা গেছে। এই সিদ্ধান্তটি ছিল দোষী সাব্যস্ত যৌন অপরাধী জেফ্রি এপস্টেইনের সাথে তাঁর বিতর্কিত সম্পর্কের বিষয়ে নতুন তথ্য প্রকাশের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক জনরোষের সরাসরি ফল। বাকিংহাম প্যালেস দ্রুত এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং ঘোষণা করে যে এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো রাজমুকুটের নিশ্ছিদ্র ভাবমূর্তি রক্ষা করা এবং একই সাথে সহিংসতার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের প্রতি রাজতন্ত্রের পক্ষ থেকে সংহতি প্রদর্শন করা। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে রাজতন্ত্র একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে নৈতিকতা ও জনগণের আস্থা রক্ষা করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
উপাধি বাতিলের ফলস্বরূপ, অ্যান্ড্রু এখন থেকে কেবল অ্যান্ড্রু মাউন্টবেটেন-উইন্ডসর নামে পরিচিত হবেন। তিনি তাঁর সম্মানসূচক পদবি 'হিজ রয়্যাল হাইনেস' (His Royal Highness) স্থায়ীভাবে হারালেন, যদিও তিনি জনসমক্ষে এবং দাপ্তরিক কাজে ২০২২ সাল থেকেই এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রাজার এই পদক্ষেপের কারণে তাঁকে তাঁর দীর্ঘদিনের বাসস্থান রয়্যাল লজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। উইন্ডসর পার্কের এই সুবিশাল রাজকীয় এস্টেটে তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছিলেন। তাঁর নতুন ঠিকানা হবে নরফোকের স্যান্ড্রিংহাম এস্টেটের অভ্যন্তরে একটি ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্ট। এটি লক্ষণীয় যে, কিং চার্লস III তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অ্যান্ড্রুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থায়ন করবেন, যা রাজপরিবারের অভ্যন্তরে একটি অস্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাজতন্ত্রের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ঘোষণার আগে, ১৭ অক্টোবর প্রিন্স অ্যান্ড্রু নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি স্বেচ্ছায় ডিউক অফ ইয়র্ক উপাধি এবং অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অর্ডার অফ দ্য গার্টার সহ বেশ কয়েকটি নাইটহুড পদমর্যাদা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তটি এমন এক সময়ে আসে যখন তাঁর বিরুদ্ধে জনদাবি তুঙ্গে ছিল। বিশেষত, ভার্জিনিয়া জিউফ্রের মরণোত্তর স্মৃতিকথা থেকে প্রকাশিত কিছু মর্মস্পর্শী অংশ জনসাধারণের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। জিউফ্রের পরিবার এই ঘটনাকে তাদের "অবিশ্বাস্য সাহস ও সত্যের" মাধ্যমে অর্জিত একটি নৈতিক বিজয় হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক ইতিহাসে রাজপরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নেওয়া এটি সবচেয়ে আমূল পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি।
যদিও অ্যান্ড্রু তাঁর রাজকীয় মর্যাদা ও উপাধি হারিয়েছেন, তবুও তাঁর আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি রাজার কাছ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য ছয়-অঙ্কের ক্ষতিপূরণ এবং বার্ষিক ভাতা পাবেন। অন্যদিকে, তাঁর কন্যারা, প্রিন্সেস বিয়াট্রিস এবং প্রিন্সেস ইউজিনিয়া, তাঁদের রাজকীয় উপাধি বজায় রাখবেন। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য জনগণের তীব্র দাবি, প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় কাঠামোগুলিকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এই বিষয়ে জনমত যাচাই করে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৭৯% উত্তরদাতা রাজার এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। তবে, একই সাথে ৫৮% উত্তরদাতা মনে করেন যে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে এই প্রতিক্রিয়াটি আসতে অনেক দেরি হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে মিশ্র অনুভূতির ইঙ্গিত দেয়।
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর উপাধি বাতিলের এই 'শুদ্ধিকরণ' প্রক্রিয়াটি কেবল রাজকীয় সম্মাননাতেই থেমে থাকেনি; সামরিক পদমর্যাদার ক্ষেত্রেও তা প্রসারিত হয়। ২ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জন হিলি ঘোষণা করেন যে সরকার অ্যান্ড্রুর শেষ সম্মানসূচক সামরিক পদমর্যাদা—রয়্যাল নেভির ভাইস-অ্যাডমিরাল পদটি—বাতিল করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মন্ত্রী হিলি নিশ্চিত করেন যে এই পদক্ষেপটি সরাসরি কিং চার্লস III-এর অনুরোধে নেওয়া হয়েছে এবং এটিকে তিনি "সঠিক পদক্ষেপ" হিসেবে অভিহিত করেন, যা নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার গুরুত্বকে তুলে ধরে। উল্লেখ্য, অ্যান্ড্রু ২২ বছর ধরে নৌবাহিনীতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন এবং ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় তিনি সামরিক হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সামগ্রিক ঘটনাটি রাজতন্ত্রের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করল, যেখানে ঐতিহ্য রক্ষার চেয়ে জনগণের আস্থা ও নৈতিকতা রক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং রাজপরিবারের আধুনিকায়নের পথ সুগম হলো।
