বিজ্ঞানীরা ত্বকের কোষ থেকে কার্যকরী ডিম্বাণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি বিশেষত সেইসব মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা ক্যান্সারের চিকিৎসার মতো কারণে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা হারিয়েছেন। এই পদ্ধতিটি প্রচলিত সহায়ক প্রজনন কৌশলের (assisted reproductive techniques) সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
গবেষক Shukhrat Mitalipov ওরেগন স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং তাঁর দল এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি তৈরি করেছেন। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, রোগীর ত্বক থেকে কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোকে কার্যকরী ডিম্বাণুতে রূপান্তরিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে, ত্বকের কোষের নিউক্লিয়াস, যেখানে রোগীর ডিএনএ থাকে, তা বের করে আনা হয়। এরপর, একটি দাতা ডিম্বাণু থেকে মূল নিউক্লিয়াস সরিয়ে সেই জায়গায় ত্বকের কোষের নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করা হয়। কোষের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক ক্রোমোজোম জমা হওয়া রোধ করার জন্য, বিজ্ঞানীরা 'mitomeiosis' নামে একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি তৈরি করেছেন। এটি কোষ বিভাজনের স্বাভাবিক ধাপগুলো অনুকরণ করে অতিরিক্ত ক্রোমোজোম বাদ দেয়, ফলে সঠিক জেনেটিক উপাদানে একটি ডিম্বাণু তৈরি হয়।
এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ৮২টি পর্যন্ত কার্যকরী ডিম্বাণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে, এই ডিম্বাণুগুলোকে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৯% ডিম্বাণু ব্লাস্টোসিস্ট (blastocyst) পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে, যা স্বাভাবিক আইভিএফ (IVF) ভ্রূণ স্থানান্তরের জন্য উপযুক্ত সময়। বর্তমান নিয়মাবলী মেনে চলার কারণে এই ভ্রূণগুলোকে এর বেশি কালচার করা হয়নি, তবে সমস্ত লক্ষণ তাদের সম্ভাব্য কার্যকারিতা নির্দেশ করে।
গবেষকরা জানিয়েছেন যে, এই পরীক্ষামূলক কৌশলটি বিশ্বব্যাপী ল্যাবরেটরিতে প্রয়োগের আগে এখনও অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে। বেশিরভাগ ভ্রূণ প্রাথমিক পর্যায়েই বিকশিত হওয়া বন্ধ করে দেয় এবং কিছু ব্লাস্টোসিস্টে ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা দেখা গেছে। তাই, এই পদ্ধতির ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করে কোষের 'এপিজেনেটিক মেমরি' (epigenetic memory) দূর করা এবং উৎপন্ন ভ্রূণগুলো একটি সম্পূর্ণ জীবন্ত সত্তা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কোষ তৈরি করতে পারে কিনা তার উপর।
এই নতুন প্রযুক্তিটি বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়জনে একজন প্রজননক্ষম ব্যক্তি জীবনে কোনো না কোনো সময়ে বন্ধ্যাত্বের শিকার হন। এই নতুন পদ্ধতিটি সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আশার আলো বয়ে আনতে পারে যারা প্রচলিত চিকিৎসায় সফল হননি। তবে, ক্লিনিকাল প্রয়োগের জন্য এখনও অনেক পথ বাকি এবং এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। এই গবেষণাটি 'Nature Communications' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অফ সাউথাম্পটনের অধ্যাপক Ying Cheong বলেছেন, “প্রথমবারের মতো, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে সাধারণ কোষের ডিএনএ একটি ডিম্বাণুতে স্থাপন করে সেটিকে গ্যামেটের মতো বিভাজিত হতে বাধ্য করা যায়। এটি একটি উত্তেজনাপূর্ণ অগ্রগতি, যদিও বর্তমানে এটি সীমিত পরীক্ষাগার সাফল্য এবং ক্লিনিকাল বাস্তবতার থেকে অনেক দূরে।” ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গের Richard Anderson উল্লেখ করেছেন যে, ক্যান্সারের চিকিৎসার মতো কারণে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা হারানো মহিলাদের জন্য এটি একটি বিশাল অগ্রগতি হতে পারে।
তবে, এই প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে কিছু নৈতিক বিতর্কও সামনে এসেছে। গ্রুপো ইউআর ইন্টারন্যাশনাল-এর Rocío Núñez Calonge আমেরিকান সোসাইটি ফর রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিনের এথিক্স কমিটির অতীতের উদ্বেগগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যা সোম্যাটিক কোষ নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার ব্যবহার করে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার নিরাপত্তা এবং সামাজিক পরিণতি সম্পর্কিত ছিল। ইউনিভার্সিটি অফ হালের অধ্যাপক Roger Sturmey মনে করেন, এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়া এবং সমাজের সাথে আলোচনা খোলা রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “এই কাজটি বৈজ্ঞানিকভাবে চিত্তাকর্ষক, তবে আমরা এখনও ক্লিনিকাল প্রয়োগের অনেক দূরে। এই ধরনের অগ্রগতিগুলি জন আস্থা নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী নৈতিক এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে শক্তিশালী করে।”
এই গবেষণাটি বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে, তবে এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার এবং নৈতিক দিকগুলো নিয়ে আরও গভীর আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।