প্রাচীন মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান কারনাক মন্দির কমপ্লেক্সের উৎস সম্পর্কে একটি যুগান্তকারী ভূ-প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন যে মন্দিরটির অবস্থান প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারে। ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন (যুক্তরাজ্য) এবং উপসালা ইউনিভার্সিটি (সুইডেন)-এর বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে এই গবেষণায় প্রায় ৩,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারনাক এলাকার পরিবর্তন পুনর্গঠন করা হয়েছে।
গবেষকরা ৬১টি পলল কোর এবং হাজার হাজার মৃৎপাত্রের ভাঙা অংশ বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করেছেন, কিভাবে নদীর গতিপথ বিভিন্ন সময়ে এই পবিত্র এলাকার গঠন ও সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছে। তাদের মতে, কারনাকের প্রাচীনতম স্থায়ী বসতি সম্ভবত পুরাতন রাজ্যকালে (প্রায় ২৫৯১–২১৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গড়ে উঠেছিল, এবং মন্দির নির্মাণ কার্যক্রম প্রায় ২৩০০–১৯৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে শুরু হয়েছিল।
গবেষকরা মনে করেন যে মন্দির এলাকার মূল ভূমি একটি দ্বীপ ছিল, যা প্রাচীন নীলনদের দুটি শাখার মাঝে গঠিত হয়েছিল। পশ্চিম ও পূর্বের গভীর চ্যানেলগুলি উচ্চতায় প্রায় ৭২ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঠে বসতি স্থাপন এবং মন্দির নির্মাণের জন্য শক্ত ভিত্তি সরবরাহ করেছিল। প্রাপ্ত পলল এবং মৃৎপাত্রের তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই এলাকাটি প্রায় ২৫২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে বন্যার কারণে দীর্ঘমেয়াদী বসতির জন্য অনুপযুক্ত ছিল বলে মনে করেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, নদীর শাখাগুলি স্থানান্তরিত হয়েছে এবং পলি জমেছে, যা মন্দির কমপ্লেক্সের সম্প্রসারণের জন্য আরও স্থান তৈরি করেছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে পূর্ব দিকের নদীর শাখা, যা আগে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত, প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমের শাখার চেয়ে প্রশস্ত এবং প্রভাবশালী ছিল। এছাড়াও তারা মনে করেন যে প্রাচীন মিশরীয়রা এই স্থানকে আরও উপযোগী করতে নদীর শাখায় মরুভূমির বালি ঢালার মাধ্যমে পরিবেশ পরিবর্তন করেছিল, যা মন্দির নির্মাণ এবং ভিত্তি স্থিতিশীল করার জন্য করা হয়েছিল।
গবেষকরা আরও মনে করেন যে কারনাক মন্দিরের অবস্থান এবং তার প্রকৃতি প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তারা উল্লেখ করেন যে, মন্দির যে দ্বীপে নির্মিত হয়েছে, সেটি ওই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু ভূমি ছিল এবং এর অবস্থান সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচিত হয়েছিল যাতে তা ‘সৃষ্টির ঢিবি’ হিসেবে প্রতিফলিত হয়। মধ্য রাজ্যকালে এই ধারণাটি আরও দৃঢ় হয়েছিল, কারণ মন্দিরটি এমন জমিতে নির্মিত হয়েছিল যা বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয়, যা আদিম মহাসাগর থেকে ‘প্রথম ভূমি’ উত্থিত হওয়ার একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
গবেষকরা বর্তমানে লুক্সরের সমগ্র বন্যাভূমি জরিপ করছেন, যাতে প্রাচীন থিবসের ধর্মীয় কেন্দ্রের গঠন এবং জলবিদ্যার প্রভাব আরও ভালোভাবে বোঝা যায়। এই আবিষ্কার শুধুমাত্র কারনাক মন্দিরের গঠনের প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করে না, বরং প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে মানুষ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।