১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে মহাকাশ থেকে আসা এক শক্তিশালী ও অস্বাভাবিক রেডিও সংকেত, যা 'ওয়াও!' সিগন্যাল নামে পরিচিত, তা নিয়ে নতুন গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই সংকেতটি মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক গভীর রহস্যের সৃষ্টি করেছিল, যা এতদিন এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণীর যোগাযোগের সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচিত হত। তবে, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং একটি জ্যোতির্পদার্থিক উৎসের দিকে ইঙ্গিত করছে। ১৯৭৭ সালের ১৫ই আগস্ট, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির বিগ ইয়ার রেডিও টেলিস্কোপ একটি শক্তিশালী ও অস্বাভাবিক ৭২ সেকেন্ডের রেডিও সংকেত সনাক্ত করে, যা ধনু রাশির দিক থেকে আসছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরি আর. এহম্যান এই সংকেতের অপ্রত্যাশিত প্রকৃতি দেখে ডেটা প্রিন্টআউটে বিস্ময়সূচক মন্তব্য 'ওয়াও!' লিখে দেন, যা এই ঘটনার নামকরণ করে। দীর্ঘ দশক ধরে এই সংকেতের উৎস নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলেছে, যার মধ্যে ভিনগ্রহের সভ্যতা থেকে আসা বার্তা, প্রাকৃতিক ঘটনা বা পৃথিবীর কোনো উৎসের সংকেত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল।
সাম্প্রতিক গবেষণা, যার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাবেল মেন্ডেজ-এর নেতৃত্বাধীন একটি কাজও রয়েছে, প্রস্তাব করেছে যে এই সংকেতটি একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক 'ম্যাসার' (maser) থেকে উৎপন্ন হতে পারে। ম্যাসার হলো এক ধরণের প্রাকৃতিক লেজার, যা হাইড্রোজেন মেঘের মধ্যে বিকিরণের মিথস্ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়, বিশেষ করে যখন নিউট্রন তারার মতো কোনো মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে এর সংযোগ ঘটে। এই নতুন গবেষণাগুলি, বিশেষ করে 'আরিসিবিও ওয়াও! II' (Arecibo Wow! II) শীর্ষক একটি গবেষণা, যা আগস্ট ২০২৫-এ arXiv-এ প্রকাশিত হয়েছে, সংকেতটির সম্ভাব্য উৎসকে দুটি নির্দিষ্ট মহাকাশীয় অঞ্চলে চিহ্নিত করেছে এবং এর সর্বোচ্চ ফ্লাক্স ঘনত্ব ২৫০ Jy-এর বেশি বলে পরিমাপ করেছে। এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, ছোট, শীতল হাইড্রোজেন মেঘগুলি 'ওয়াও!' সিগন্যালের মতো সংকীর্ণ-ব্যান্ড সংকেত তৈরি করতে পারে, যা একটি জ্যোতির্পদার্থিক ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। অ্যাবেল মেন্ডেজ এবং তাঁর সহকর্মীরা ২০২০ সালে আরিসিবিও অবজারভেটরি থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন যে, মহাকাশে এমন কিছু সংকেত রয়েছে যা 'ওয়াও!' সিগন্যালের অনুরূপ, যদিও সেগুলি কম শক্তিশালী। এই সংকেতগুলি মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা শীতল পারমাণবিক হাইড্রোজেন মেঘ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাঁদের মতে, একটি শক্তিশালী মহাজাগতিক উৎস, যেমন একটি ম্যাগনেটার (magnetar) থেকে নির্গত বিকিরণ এই হাইড্রোজেন মেঘকে উত্তেজিত করে তোলে এবং ম্যাসার-এর মতো আলো তৈরি করে, যা 'ওয়াও!' সিগন্যালের মতো একটি শক্তিশালী সংকেত হিসেবে সনাক্ত হতে পারে। এই ব্যাখ্যাটি সংকেতটির ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিরও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, কারণ এই ধরণের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। এই নতুন গবেষণাগুলি 'ওয়াও!' সিগন্যালের উৎস সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও উন্নত করেছে এবং এটি প্রমাণ করে যে মহাকাশে এমন অনেক প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটতে পারে যা পূর্বে কেবল কৃত্রিম সংকেত হিসেবেই বিবেচিত হত। যদিও এই রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান এখনও হয়নি, তবে জ্যোতির্পদার্থিক ব্যাখ্যাগুলি ভিনগ্রহের প্রাণীর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং মহাকাশের গভীর রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকেই তুলে ধরেছে।