মহাকাশ গবেষকরা ১লা জুলাই, ২০২৫ তারিখে সৌরজগতের বাইরে থেকে আগত এক অভূতপূর্ব বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে 3I/ATLAS (C/2025 N1)। এটি আমাদের সৌরজগতে প্রবেশ করা তৃতীয় মহাজাগতিক বস্তু, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে কৌতূহল ও গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে। এর পূর্বে ২০১৭ সালে 1I/ʻOumuamua এবং ২০১৯ সালে 2I/Borisov নামক দুটি মহাজাগতিক বস্তু শনাক্ত করা হয়েছিল। 3I/ATLAS-এর বৈশিষ্ট্যগুলি প্রচলিত অনেক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই বস্তুটি কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) সমৃদ্ধ, যা জলীয় বরফের (H₂O) চেয়ে অনেক বেশি। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এটি কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বরফ, জলীয় বাষ্প, কার্বন মনোক্সাইড এবং কার্বনিল সালফাইডে সমৃদ্ধ। এই অস্বাভাবিক রাসায়নিক গঠন এটিকে অন্যান্য পরিচিত ধূমকেতু থেকে আলাদা করে তুলেছে। এটি সূর্য থেকে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মাইল দূরে থাকা অবস্থায় জল ও অন্যান্য উদ্বায়ী পদার্থ নিঃসরণ শুরু করেছে, যা সাধারণত এই দূরত্বে ঘটে না। কিছু পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এর নিউক্লিয়াসের আকার প্রায় ৩ মাইল ব্যাসের, আবার কিছু অনুমান অনুযায়ী এটি ৬ থেকে ১২ মাইল পর্যন্ত হতে পারে, যা এটিকে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বৃহত্তম মহাজাগতিক বস্তুগুলির মধ্যে একটি করে তুলতে পারে।
3I/ATLAS একটি অধিবৃত্তাকার (hyperbolic) পথে ভ্রমণ করছে, যা নির্দেশ করে যে এটি সূর্যের মহাকর্ষীয় টানে আবদ্ধ নয় এবং কেবল আমাদের সৌরজগতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর গতিবেগ আনুমানিক ১৩০,০০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, এর কক্ষপথ পৃথিবীর সৌরজগতের গ্রহগুলির কক্ষপথের সমতলের প্রায় সমান্তরাল হলেও এটি বিপরীত দিকে (retrograde motion) ঘুরছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে ৩রা অক্টোবর, ২০২৫ তারিখ থেকে রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে 3I/ATLAS-কে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এর উজ্জ্বলতা এতটাই বেশি যে সাধারণ বাড়ির টেলিস্কোপ ব্যবহার করেও এটি দেখা সম্ভব হবে। পর্যবেক্ষণের সেরা সময়কাল অক্টোবর ২০২৫ থেকে জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ২৯শে অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসবে (perihelion) এবং ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ তারিখে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসবে। নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ২১শে জুলাই, ২০২৫ তারিখে এটিকে প্রায় ২৭৭ মিলিয়ন মাইল দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে এর ধুলিকণা দ্বারা বেষ্টিত একটি অশ্রুবিন্দু-আকৃতির আবরণ শনাক্ত করেছে।
কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, 3I/ATLAS আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির 'কসমিক নুন' (cosmic noon) পর্বের একটি অবশিষ্টাংশ হতে পারে, যা প্রায় ৯-১৩ বিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিল যখন নক্ষত্র গঠন প্রক্রিয়া অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। এটি আমাদের সৌরজগতের চেয়েও প্রাচীন হতে পারে এবং অন্য নক্ষত্রমণ্ডলগুলির গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দিতে পারে। হার্ভার্ডের অধ্যাপক আভি লোয়েব এটিকে একটি বহির্জাগতিক প্রযুক্তি বা মহাকাশযান হিসেবেও কল্পনা করেছেন, যা বৈজ্ঞানিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তবে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যাপক ক্রিস লিনটট বলেছেন যে মহাজাগতিক বস্তুগুলি আমাদের ছায়াপথে অত্যন্ত সাধারণ এবং আমরা মাত্র তিনটি শনাক্ত করেছি, যা বেশ আকর্ষণীয়। নাসা-র প্রধান বিজ্ঞানী টম স্ট্যাটলারও মনে করেন যে 3I/ATLAS একটি ধূমকেতুর মতোই আচরণ করছে এবং এটি একটি প্রাকৃতিক বস্তু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মঙ্গল মিশন এবং মঙ্গল গ্রহের কিউরিওসিটি ও পারসিভারেন্স রোভারগুলিও 3I/ATALS-কে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি থাকবে। এই ধরনের পর্যবেক্ষণগুলি মহাজাগতিক বস্তুগুলির গঠন এবং তাদের উৎস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও গভীর করবে। এই মহাজাগতিক আগন্তুক আমাদের মহাবিশ্বের বিশালতা এবং বৈচিত্র্যের এক ঝলক দেখায়। এটি কেবল একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় ঘটনা নয়, বরং আমাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির সীমাকে প্রসারিত করার এক সুযোগ। এই নতুন তথ্যগুলি মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে এবং আমাদের মহাজাগতিক যাত্রায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক হবে।