দক্ষিণ কোরিয়ার জিন্দো দ্বীপে প্রতি বছর বসন্ত ও শরতের বিষুব সংক্রান্তির সময় এক অসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে, যা 'জিন্দো মিরাকল' নামে পরিচিত। এই সময়ে, সমুদ্র প্রায় এক ঘণ্টার জন্য সরে গিয়ে প্রায় ২.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৪০ থেকে ৬০ মিটার প্রশস্ত একটি বালুকাময় পথ উন্মুক্ত করে দেয়, যা জিন্দো দ্বীপকে ছোট মোডো দ্বীপের সাথে সংযুক্ত করে। এই পথ ধরে হাজার হাজার মানুষ দুই দ্বীপের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিয়ের ল্যান্ডি এই ঘটনাটিকে 'মোজেসের অলৌকিক ঘটনার কোরিয়ান সংস্করণ' হিসেবে বর্ণনা করার পর এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করে।
এই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো অত্যন্ত নিম্ন জোয়ার, যা চন্দ্রচক্র, ভৌগোলিক অবস্থান এবং সমুদ্র স্রোতের সমন্বয়ে ঘটে। চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষীয় টান সমুদ্রপৃষ্ঠে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং মহাকাশীয় বস্তুগুলোর আপেক্ষিক দূরত্ব এই ব্যতিক্রমী নিম্ন জোয়ারের কারণ, যা এই পথটিকে দৃশ্যমান করে তোলে। টেক্সাসের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক কেভান মফেটের মতে, এটি একাধিক স্বতন্ত্র 'হারমোনিক' কারণের সমন্বয়, যা একটি শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করে।
এই ঘটনার সাথে একটি স্থানীয় কিংবদন্তি জড়িত। কথিত আছে, একসময় একটি বাঘ গ্রামবাসীদের জিন্দো থেকে মোডো দ্বীপে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তারা বৃদ্ধা বাইয়ং-কে ভুলে গিয়েছিল। তিনি সমুদ্রের দেবতা ইয়ংওয়াং-এর কাছে সাহায্যের জন্য দিনরাত প্রার্থনা করেছিলেন। দেবতা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে সমুদ্রের উপর একটি রামধনু সেতু তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে বাইয়ং জেগে উঠে দেখেন যে জল সরে গেছে এবং তার সামনে একটি রামধনু-আকৃতির পথ তৈরি হয়েছে, যা তাকে পরিবারের সাথে পুনরায় মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
এই কিংবদন্তিটি প্রতি বছর জিন্দো সি পাথ মিরাকল ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, যেখানে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই জিন্দো ঘটনাটি প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার পর্যটককে আকর্ষণ করে, যারা এই অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য আসেন। এই উৎসবটি শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়ই নয়, এটি জিন্দোর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক উদযাপনও বটে। এখানে ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান নৃত্য, গান, এবং স্থানীয় খাবারের আয়োজন করা হয়। পর্যটকরা এই সময় সমুদ্রের তলদেশে হেঁটে বেড়ানোর পাশাপাশি ঝিনুক, অক্টোপাস এবং অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার সংগ্রহ করার সুযোগ পান। এই উৎসবটি কোরিয়ার অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যা প্রকৃতির শক্তি এবং মানুষের বিশ্বাসের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।