তিমি হাঙ্গর (Rhincodon typus) হলো পৃথিবীর বৃহত্তম মাছ, যা প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং প্রায় ৩০ টন ওজন ধারণ করতে পারে। এই বিশাল জলজ প্রাণীটি দেখতে ভয়ংকর হলেও আসলে এটি অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির এবং প্রধানত প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে জীবন ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এদের জীবনকাল প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত হতে পারে, যদিও এদের জীবনযাত্রার অনেক রহস্য এখনও অজানা।
তিমি হাঙ্গরের শরীরের সাদা ছোপগুলো রাতের আকাশের তারার মতো দেখতে লাগে। এই নকশা প্রতিটি হাঙ্গরের জন্য স্বতন্ত্র এবং গবেষকরা এটি ব্যবহার করে তাদের শনাক্ত করেন। এদের মাথা চওড়া ও চ্যাপ্টা ধরনের হয় এবং বেশিরভাগ হাঙ্গরের মতো মুখের নিচে না থেকে মুখের সামনেই এদের মুখ অবস্থিত। হাজার হাজার ক্ষুদ্র দাঁত থাকা সত্ত্বেও, এই দাঁতগুলো খাদ্যগ্রহণের জন্য ব্যবহৃত হয় না। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, তিমি হাঙ্গর কেবল প্ল্যাঙ্কটনই নয়, ক্রিল, ছোট মাছ এবং মাছের ডিমও খেয়ে থাকে।
তিমি হাঙ্গর বিশ্বজুড়ে উষ্ণমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বাস করে। এদের দেখার জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান হলো: মেক্সিকো, হলোবক্স ও মুজেরেস দ্বীপপুঞ্জ (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে প্ল্যাঙ্কটনের প্রাচুর্যের সময়); তানজানিয়া, মাফিয়া দ্বীপ (অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত); মালদ্বীপ, দক্ষিণ আরি অ্যাটল (সারা বছরই এদের দেখা মেলে); অস্ট্রেলিয়া, নিঙ্গালু রিফ (মার্চ থেকে আগস্ট মাস, প্রবাল প্রাচীরের প্রজনন সময়ের সাথে মিলে যায়); এবং ইন্দোনেশিয়া, সুম্বাওয়া (জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস, বিশেষ করে অমাবস্যার সময় এদের দেখা বেশি মেলে)। ভ্রমণের সময় এমন ট্যুর অপারেটর নির্বাচন করা উচিত যারা দায়িত্বশীল পর্যটন নীতি মেনে চলে। এদের স্পর্শ করা বা খাওয়ানো উচিত নয় এবং এদের নৌকা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি।
ভুলবশত এদের খুব কাছে সাঁতার কাটা বা স্পর্শ করার চেষ্টা করলে হাঙ্গরটি দূরে সরে যেতে পারে এবং নৌকা বা প্রপেলারের আঘাতে আহত হতে পারে। এর বিকল্প হলো নিরাপদ দূরত্ব থেকে পর্যবেক্ষণ করা, মাস্ক, স্নরকেল বা GoPro ক্যামেরা ব্যবহার করা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ট্যুর গ্রহণ করলে হাঙ্গরের আচরণে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং জরিমানা হতে পারে। এর বিকল্প হলো সংরক্ষণ কাজে বিনিয়োগকারী সার্টিফাইড ডাইভিং সেন্টার ব্যবহার করা উচিত।
তিমি হাঙ্গর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে বিশাল পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন গ্রহণ করে এবং সমুদ্রের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের বিলুপ্তি সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এদের টিকে থাকার জন্য মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি।
কিছু আকর্ষণীয় তথ্য:
তিমি হাঙ্গর ১৯০০ মিটারেরও বেশি গভীরে ডুব দিতে পারে।
গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে দেখা প্রায় ৯০% তিমি হাঙ্গরই গর্ভবতী মহিলা।
১৯৯৫ সালে তাইওয়ানের উপকূলে একটি স্ত্রী তিমি হাঙ্গর পাওয়া গিয়েছিল যার পেটে ৩০০টি ভ্রূণ ছিল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
১৮২৮ সালে এই প্রজাতিটি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ণিত হয়।
১৯৯৫ সালে এরা যে জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে (ovoviviparity) তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে IUCN (International Union for Conservation of Nature) এদের বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
তিমি হাঙ্গর আমাদের সমুদ্রের বিশালতা এবং এর বৃহত্তম বাসিন্দাদের ভঙ্গুরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এদের অস্তিত্ব আমাদের দায়িত্বশীল সমুদ্র ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। এই বিশাল মাছেরা পৃথিবীর উষ্ণমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় সমুদ্রগুলিতে বাস করে, সাধারণত উত্তর অক্ষাংশের ৩০ ডিগ্রি থেকে দক্ষিণ অক্ষাংশের ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে এদের দেখা যায়। এরা উপকূলীয় এবং গভীর সমুদ্র উভয় অঞ্চলেই বিচরণ করে। এদের জীবনকাল ৮০ থেকে ১৩০ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং কিছু অনুমান অনুযায়ী ১৫০ বছর পর্যন্ত বলে অনুমান করা হয়। এরা মূলত প্ল্যাঙ্কটন এবং ছোট মাছ খেয়ে থাকে, তাই মানুষের জন্য এরা কোনো হুমকি নয়। এদের শরীরের স্বতন্ত্র সাদা ছোপগুলো প্রত্যেকটির জন্য আলাদা, যা গবেষকদের এদের শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এদের মুখ সামনের দিকে অবস্থিত এবং এতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র দাঁত থাকলেও তা খাদ্যগ্রহণে ব্যবহৃত হয় না। এদের সংরক্ষণের জন্য বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষণা ও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কারণ এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। গত ৭৫ বছরে তিমি হাঙ্গরের সংখ্যা ৫০% এর বেশি কমে গেছে। এদের বিলুপ্তি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।