দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি হিসেবে বহুভাষিকতা
সম্পাদনা করেছেন: Liliya Shabalina
নেচার এজিং-এর ৮৬,০০০ মানুষের উপর করা গবেষণা কী দেখাল
যখন আমরা দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন নিয়ে চিন্তা করি, তখন সাধারণত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং পর্যাপ্ত ঘুমের কথাই মনে আসে। কিন্তু এমন একটি সহজ, অথচ অবিশ্বাস্য শক্তিশালী উপাদান রয়েছে যা সকলের জন্য সহজলভ্য—আর তা হলো একাধিক ভাষা জানা।
সম্প্রতি নেচার এজিং (Nature Aging) জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ইউরোপের ২৭টি দেশের ৮৬,১৪৯ জন মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: বহুভাষিকতা উচ্চতর জ্ঞানীয় স্থিতিস্থাপকতা (cognitive resilience) এবং শরীরের একটি স্বাস্থ্যকর "বার্ধক্য প্রোফাইলের" সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
এটি কেবল কথার কথা নয়। এটি একটি বিশাল, তথ্য-ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল।
গবেষকরা ঠিক কী খুঁজে পেয়েছেন
১. যারা একাধিক ভাষা ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘায়ুর লক্ষণ বেশি দেখা যায়
গবেষণায় 'বায়োবিহেভিওরাল এজ গ্যাপ' (Biobehavioral Age Gap বা BAG) নামক একটি সূচক ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সূচকটি নির্দেশ করে যে একজন ব্যক্তির শরীর ও মস্তিষ্ক তার প্রকৃত ক্যালেন্ডার বয়সের তুলনায় কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যারা একাধিক ভাষায় কথা বলেন, তাদের BAG স্কোর উল্লেখযোগ্যভাবে 'কম বয়সী' ছিল। এর অর্থ হলো, তাদের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো আরও স্থিতিশীল এবং কার্যকরভাবে কাজ করছিল।
২. একভাষিকতা বা মনো-লিঙ্গুয়ালিজম বার্ধক্যজনিত সমস্যার উচ্চ ঝুঁকির সাথে যুক্ত
গবেষণায় দেখা গেছে, যে অংশগ্রহণকারীরা কেবল একটি ভাষায় কথা বলতেন, তাদের মধ্যে 'প্রতিকূল বার্ধক্য প্রোফাইল' (unfavorable age profile) গোষ্ঠীতে থাকার সম্ভাবনা বহুভাষিকদের তুলনায় প্রায় ২.১ গুণ বেশি ছিল।
৩. যত বেশি ভাষা, তত বেশি মানসিক সম্পদ
বিজ্ঞানীরা একটি স্পষ্ট ডোজ-নির্ভর প্রভাব লক্ষ্য করেছেন: মানুষ তার জীবনে যত বেশি ভাষা ব্যবহার করে, তার বার্ধক্য প্রোফাইল তত বেশি অনুকূল দেখায়।
এটি প্রমাণ করে যে বহুভাষিকতা মস্তিষ্কের জন্য দীর্ঘমেয়াদী জ্ঞানীয় স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করে—যা এক প্রকার 'সুরক্ষা কুশন' বা সেফটি নেট হিসেবে কাজ করে।
৪. অন্যান্য কারণ বিবেচনা করার পরেও প্রভাবটি বজায় ছিল
গবেষকরা তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করার সময় বহু ডজন প্যারামিটার বা মানদণ্ড বিবেচনা করে সামঞ্জস্য এনেছিলেন। এই প্যারামিটারগুলোর মধ্যে ছিল:
স্বাস্থ্য
জীবনধারা
শিক্ষা
সামাজিক কার্যকলাপ
বিভিন্ন দেশের বৈশিষ্ট্য
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান
এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করার পরেও, বহুভাষিকতা একটি স্বাধীন কারণ হিসেবেই রয়ে গেছে, যা দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত।
ভাষা কেন দীর্ঘায়ু বজায় রাখতে সাহায্য করে?
বিষয়টি খুবই সহজ: ভাষা হলো মস্তিষ্কের জন্য এক ধরনের 'ফিটনেস' বা ব্যায়াম।
প্রতিবার যখন আমরা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় পরিবর্তন করি, শব্দ মনে করার চেষ্টা করি বা কোনো বিদেশী ভাষা শুনি, তখন আমাদের স্নায়ু সংযোগগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে।
এটি একটি মৃদু, নিয়মিত প্রশিক্ষণের প্রভাব তৈরি করে, যা:
জ্ঞানীয় কার্যকারিতা শক্তিশালী করে
নিউরোপ্লাস্টিসিটি উন্নত করে (মস্তিষ্কের নমনীয়তা)
চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা বজায় রাখে
মস্তিষ্কের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
অর্থাৎ, এটি মস্তিষ্ককে দীর্ঘদিন ধরে বাঁচতে এবং আরও স্থিতিশীলভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
৪০, ৫০ বা ৭০ বছর বয়সে শুরু করলে কি কোনো ফল পাওয়া যাবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
গবেষণাটি একাধিক ভাষার ব্যবহার এবং একটি স্বাস্থ্যকর বার্ধক্য প্রোফাইলের মধ্যে সংযোগ দেখায়। এর মানে হলো: আপনি কখন শুরু করেছিলেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বর্তমানে আপনি ভাষাটি ব্যবহার করছেন কিনা, সেটাই আসল বিষয়।
দেরিতে শুরু করা কোনো বাধা নয়। বরং এটি একটি অতিরিক্ত সুবিধা।
কীভাবে সহজে জীবনে ভাষা যোগ করবেন
আপনাকে বহুভাষাবিদ বা পলিগ্লট হওয়ার দরকার নেই। দীর্ঘায়ু বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন নিয়মিততা, পরিমাণের আধিক্য নয়।
আপনি চেষ্টা করতে পারেন:
সাবটাইটেল সহ অন্য ভাষার সিরিজ দেখা
প্রতিদিন কয়েকটি নতুন শব্দ শেখা
পডকাস্ট বা গান শোনা
সংক্ষিপ্ত খবর পড়া
চ্যাট বা মেসেজিংয়ে সেই ভাষা ব্যবহার করা
শেখা ভাষায় অডিও বা ভিডিও নোট তৈরি করা
মূল কথা হলো—ভাষা যেন আপনার দৈনন্দিন জীবনে সক্রিয়ভাবে বেঁচে থাকে।
উপসংহার
বহুভাষিকতা মানে "বার্ধক্য এড়িয়ে যাওয়া" নয়। এর অর্থ হলো মানসিক সম্পদ, স্বচ্ছতা, দীর্ঘ সক্রিয় জীবন এবং একটি স্থিতিশীল মস্তিষ্ক অর্জন করা।
এটি দীর্ঘায়ু বজায় রাখার জন্য একটি সহজ, মৃদু এবং সকলের জন্য সহজলভ্য উপায়।
উৎসসমূহ
Diario Panorama
Nature Portfolio
Global Brain Health Institute
Euronews
এই বিষয়ে আরও খবর পড়ুন:
আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?
আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।
