দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সংসদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) চালিত ডিজিটাল পাঠ্যপুস্তককে সরকারি শিক্ষা উপকরণের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে, পূর্ববর্তী সরকারের শিক্ষা সংস্কার প্রকল্প বড় ধরনের ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে। এই সংশোধনীতে পাঠ্যপুস্তকের আইনি সংজ্ঞা কেবল মুদ্রিত বই এবং ই-বুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা “বুদ্ধিমত্তিসম্পন্ন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারী শিক্ষা সহায়ক সফটওয়্যার” বাদ দিয়েছে। এর ফলে, এআই-চালিত পাঠ্যপুস্তকগুলোকে সাধারণ শিক্ষা উপকরণ হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে, সরকারি পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপটি অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে, যা বিদ্যালয়গুলোতে এআই ডিজিটাল পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের আইনি ও আর্থিক ভিত্তি সরিয়ে দিয়েছে।
এই সংশোধনীটি মূলত ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টি অব কোরিয়া কর্তৃক খসড়া করা এবং পাস করা হয়েছে। এটি গত বছরও একই ধরনের একটি আইন পাস হয়েছিল, যা তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভেটো দেওয়ার পর বাতিল হয়ে গিয়েছিল। পূর্ববর্তী ইয়ুন সুক ইয়োল প্রশাসনের একটি ফ্ল্যাগশিপ উদ্যোগ হিসেবে এআই পাঠ্যপুস্তক চালু করা হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষার অভিজ্ঞতা প্রদান করা। গত বছর এই প্রকল্পের জন্য কমপক্ষে ৫৩৩.৩ বিলিয়ন কোরিয়ান ওন (প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ করা হয়েছিল।
তবে, এই আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা দ্রুতই অভিভাবক এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অভিভাবকদের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। অন্যদিকে, শিক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এআই প্রযুক্তি তাদের পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে এবং কর্মসংস্থান হ্রাস করতে পারে। অভিভাবকদের মধ্যে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম নিয়ে উদ্বেগ এতটাই তীব্র ছিল যে ৫৬,০০০ এরও বেশি অভিভাবক একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেন।
এই সম্মিলিত বিরোধিতার মুখে, সরকার বাধ্যতামূলক এআই পাঠ্যপুস্তক নীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এই নীতি পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এআই-সম্পর্কিত সংস্থানগুলিকে "শিক্ষাগত উপকরণ" হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করা হয়, যা তাদের সরকারি পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা এবং সংশ্লিষ্ট তহবিল থেকে বঞ্চিত করে। এই পদক্ষেপটি কেবল প্রযুক্তিগত এবং আইনগত জটিলতারই প্রতিফলন নয়, বরং কর্মসংস্থান নিয়ে বৃহত্তর উদ্বেগেরও ইঙ্গিত দেয়, যেখানে এআই শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রগুলিতে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা বাজারের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি স্পষ্ট করে যে, প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সকল অংশীদারদের উদ্বেগগুলি সাবধানে বিবেচনা করা এবং তাদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি যারা অনুরূপ এআই একীকরণের কথা ভাবছে, তারা এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। এই ঘটনার পর, দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা নীতিতে একটি স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এআই-কে এখন মানব নির্দেশনার বিকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি সহায়ক সরঞ্জাম হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই নতুন পদ্ধতিতে, প্রযুক্তি মানব শিক্ষকের ভূমিকাকে প্রতিস্থাপন না করে বরং তাকে উন্নত করার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে নৈতিক কাঠামো এবং একটি সমন্বিত মডেলকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি শিক্ষা ক্ষেত্রে গোপনীয়তা, সমতা এবং প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার মতো ঝুঁকিগুলি মোকাবেলার গুরুত্বকে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক আলোচনা এখন গণমাধ্যম সাক্ষরতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার উপর কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের পরিবর্তিত এআই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি এআই প্রযুক্তির সতর্ক বাস্তবায়ন, শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি এর ঝুঁকিগুলি প্রশমিত করার জন্য একটি সুষম পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাকেই জোরালোভাবে তুলে ধরে।
