প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, চেতনা কেবল মস্তিষ্কেরই একটি উপজাত। কিন্তু নিউরোসার্জন মাইকেল এগনর তাঁর ক্লিনিকাল অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাঁর মতে, চেতনা শারীরিক মস্তিষ্কের সীমার বাইরেও বিস্তৃত হতে পারে।
এগনরের এই ধারণা তাঁর একটি কেস স্টাডি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তিনি এক রোগীর মস্তিষ্কে ব্রেন টিউমারের জন্য সচেতন সার্জারি (awake surgery) করছিলেন। এই পদ্ধতিতে রোগী সম্পূর্ণ সজাগ থাকেন এবং অস্ত্রোপচারের সময় কথা বলতে পারেন। অস্ত্রোপচারের সময় মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের একটি অংশ, যা চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো উচ্চতর জ্ঞানীয় কার্যাবলীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা অপসারণ করা হচ্ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ অপসারণের সময়ও রোগী স্বাভাবিকভাবে কথোপকথন চালিয়ে যান এবং তাঁর জ্ঞানীয় ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে। এই ঘটনা এগনরকে ভাবতে বাধ্য করে যে, মস্তিষ্কই কি চেতনার একমাত্র উৎস?
এগনর বিখ্যাত নিউরোসার্জন ওয়াইল্ডার পেনফিল্ডের কাজের কথাও উল্লেখ করেছেন। পেনফিল্ড মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য 'মন্ট্রিল প্রসিডিউর' (Montreal Procedure) ব্যবহার করতেন। এই পদ্ধতিতে তিনি সচেতন রোগীদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা (electrical stimulation) প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ম্যাপিং করতেন। পেনফিল্ড লক্ষ্য করেছিলেন যে, মস্তিষ্কের উদ্দীপনা নির্দিষ্ট শারীরিক নড়াচড়া, স্মৃতি বা আবেগ জাগিয়ে তুলতে পারলেও, এটি বিমূর্ত চিন্তাভাবনা (abstract thought) তৈরি করতে পারত না। এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পেনফিল্ড সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, বিমূর্ত চিন্তাভাবনা বা মন মস্তিষ্কের পরিবর্তে আত্মা থেকে উদ্ভূত হয়।
এই ধারণাগুলি এগনরের লেখা 'The Immortal Mind: A Neurosurgeon’s Case for the Existence of the Soul' বইটিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যা তিনি ডেনিস ও'লিয়ারির সাথে যৌথভাবে লিখেছেন। বইটি বস্তুবাদী (materialistic) দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যা মনে করে মন কেবল মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সমষ্টি। এগনরের কাজ স্নায়ুবিজ্ঞান এবং মনের দর্শনে নতুন গবেষণার পথ খুলে দিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের গুরুতর ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও রোগীরা আশ্চর্যজনকভাবে স্পষ্টতা প্রদর্শন করতে পারেন, যা 'টার্মিনাল লুসিডটি' (terminal lucidity) নামে পরিচিত। এই ঘটনাগুলিও প্রচলিত বস্তুবাদী ধারণাগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই ধরনের পর্যবেক্ষণগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, মন এবং মস্তিষ্কের মধ্যে সম্পর্ক আরও জটিল এবং সম্ভবত আমাদের চেতনা কেবল জৈবিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি মানব চেতনা এবং অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে আরও গভীর করার সম্ভাবনা রাখে।