কায়রোতে ২০টি আফ্রিকান দেশের এক ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, যেখানে মহাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই সম্মেলনটি টেকসই উন্নয়নের কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করবে। সম্মেলনটি ১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে।
আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU) এর নেতৃত্বে আমন্ত্রিত দেশগুলো সহ বিভিন্ন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়াও উন্নয়ন ও অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও এতে যোগ দেবেন। সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মতো জরুরি বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে, যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, রোগের বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হবে। এই সম্মেলনকে একটি "মানবিক বিপর্যয়" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা "ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ নীতির" ফলস্বরূপ উদ্ভূত হয়েছে। মহাদেশে জরুরি ভিত্তিতে মানবিক ও খাদ্য সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিশরের সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের সাধারণ বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরাদ্দ করছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা এবং লক্ষ লক্ষ নাগরিকের জন্য "তাফাকুল ও কারামা" কর্মসূচির বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্ত। সম্মেলনে জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন কৌশলগুলির উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। খাদ্য নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য উদ্ভাবনী ও কার্যকর প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরি নিয়েও আলোচনা করা হবে।
আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট-এর প্রতিনিধি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়ক উপদেষ্টা রাজি এল-এট্রিবি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্য, রোগের বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তিনি এই মহাদেশের চ্যালেঞ্জগুলোকে "মানবিক বিপর্যয়" হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং জরুরি খাদ্য সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রী আহমেদ কুজুক বলেছেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষ করে মিশর, খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তিনি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য জাতীয় স্তরে সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দ্বিগুণ প্রচেষ্টা চালানোর উপর জোর দিয়েছেন। তিনি সরকারগুলোকে ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
বৈদেশিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক উপমন্ত্রী আলফিয়েন বুটিস খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক গুরুত্ব এবং এর প্রভাবের উপর আলোকপাত করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে কায়রো সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে সম্পর্কিত জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কৌশলগুলির উপর ব্যাপক প্রতিবেদন তৈরি করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরি করা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকার কৃষিক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। অসম বৃষ্টিপাত, খরা এবং বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮০% খাদ্য পারিবারিক খামার থেকে উৎপাদিত হয়, তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভুট্টা উৎপাদন ২৪% হ্রাস পেতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে। আফ্রিকার কৃষকরা, বিশেষ করে সাব-সাহারান অঞ্চলের কৃষকরা, সেচের উপর নির্ভরশীল না হওয়ায় এবং মূলত বৃষ্টির উপর নির্ভর করায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন।
আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU) ২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দূর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মহাদেশীয় উদ্যোগগুলি, যেমন Comprehensive Africa Agriculture Development Programme (CAADP), গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আফ্রিকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কৃষি-ভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে আফ্রিকার কৃষি-খাদ্য উৎপাদন ৪৫% বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য তিনগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই সম্মেলনটি আফ্রিকার খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপস্থিতি এই প্রতিশ্রুতির একটি উচ্চ স্তরের ইঙ্গিত দেয়। খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার উপর জোর দেওয়া মহাদেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং সরকারি বরাদ্দের উল্লেখগুলি এই ক্ষেত্রে গৃহীত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলির ইঙ্গিত দেয়। বক্তাদের সামগ্রিক মনোভাব জরুরি অবস্থা এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছে, যা সম্ভাব্য অগ্রগতির জন্য একটি ইতিবাচক লক্ষণ।