ভূমিকম্প-প্রবণ দেশ জাপানে, যেখানে প্রায়শই শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়, সেখানে বাড়িঘর এবং বাসিন্দাদের সুরক্ষার জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন অব্যাহত রয়েছে। এমনই একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন হলো এয়ার ড্যানশিন সিস্টেমস ইনকর্পোরেটেড (Air Danshin Systems Inc.) দ্বারা তৈরি একটি এয়ার-লিফটিং প্রযুক্তি, যা ভূমিকম্পের সময় বাড়িগুলিকে মাটি থেকে উপরে তুলে ধরে তাদের কম্পন থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই প্রযুক্তি কেবল কার্যকরই নয়, বরং এটি সাশ্রয়ী এবং বিদ্যমান ভবনগুলিতেও স্থাপন করা সম্ভব, যা এটিকে জাপানের ভূমিকম্প প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করে তুলেছে।
এই অভিনব ব্যবস্থাটি একটি স্বয়ংক্রিয় এয়ার-লিফটিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। যখন ভূমিকম্প সনাক্ত করা হয়, তখন সিস্টেমটি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে পুরো ভবনটিকে তার ভিত্তি থেকে প্রায় ৩ সেন্টিমিটার উপরে তুলে ধরে। এটি ভবনটিকে ভূমির কম্পন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কম্পন থেমে গেলে, ভবনটি ধীরে ধীরে আবার তার ভিত্তির উপর নেমে আসে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মতো জরুরি পরিস্থিতিতেও যাতে এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকে, তার জন্য এতে জরুরি ব্যাটারিও সংযুক্ত করা হয়েছে। এয়ার ড্যানশিন সিস্টেমের একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো এর সাশ্রয়ী মূল্য। প্রচলিত সিসমিক আইসোলেশন পদ্ধতির তুলনায় এর স্থাপনা খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই কারণে, এটি বাড়ির মালিক এবং ছোট ব্যবসার জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কোম্পানিটি কারখানা এবং পরীক্ষাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলির সুরক্ষার জন্য এই সিস্টেমের বৃহত্তর সংস্করণও তৈরি করেছে। এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা প্রমাণ করার জন্য, এয়ার ড্যানশিন একটি পূর্ণাঙ্গ বাড়ির উপর একটি পরীক্ষা চালিয়েছিল, যেখানে আসবাবপত্র, গৃহস্থালীর সামগ্রী এবং এমনকি ওয়াইনের গ্লাসও রাখা হয়েছিল। সিমুলেটেড ভূমিকম্পের সময় বাড়িটি মসৃণভাবে তার ভিত্তি থেকে উপরে উঠে গিয়েছিল এবং একটিও ওয়াইনের ফোঁটা পড়েনি, যা ভূমিকম্পের সময় কেবল কাঠামোই নয়, এর ভেতরের জিনিসপত্রকেও রক্ষা করার ক্ষমতার একটি প্রমাণ।
এই প্রযুক্তিটি জাপানে প্রায় ৯০টি বাড়ি এবং ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের সময়, এই প্রযুক্তিযুক্ত ৩০টি বাড়ি অক্ষত ছিল, যা এর কার্যকারিতার একটি শক্তিশালী প্রমাণ। তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ডেক স্মিথ (Deke Smith), বিল্ডিং সিসমিক সেফটি কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, উল্লেখ করেছেন যে এই সিস্টেমটি ছোট বা মূলত পার্শ্বীয় কম্পনের জন্য বেশি কার্যকর হতে পারে। বড় আকারের, বহু-মাত্রিক ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা সীমিত হতে পারে। এছাড়াও, ভূমিকম্পের প্রাথমিক ধাক্কাগুলি প্রায়শই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হয় এবং যদি প্রাথমিক কম্পনের ফলে বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে এয়ার ব্যাগটি সঠিকভাবে স্ফীত হতে সমস্যা হতে পারে এমন উদ্বেগও রয়েছে। এই উদ্বেগ সত্ত্বেও, এয়ার ড্যানশিন সিস্টেম জাপানের ভূমিকম্প প্রতিরোধে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি একটি সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য সমাধান যা ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করার সম্ভাবনা রাখে। এই উদ্ভাবনটি কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতিই নয়, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি প্রয়াসও বটে।