ব্রাসেলস থেকে ২০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জ্বালানি মন্ত্রীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছেন। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো পর্যায়ক্রমে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য দ্বিমুখী: একদিকে যেমন রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইইউ-এর নির্ভরতা কমানো, তেমনি অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়নের জন্য ব্যবহৃত ক্রেমলিনের আয়ের উৎস সীমিত করা।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন গ্যাস সরবরাহ চুক্তি নিষিদ্ধ করা হবে। বিদ্যমান চুক্তিগুলোর মেয়াদও নির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী চুক্তিগুলো ২০২৬ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিগুলো ২০২৮ সালের শুরু পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যার পরে গ্যাস আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
তেল আমদানির ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ান তেল আমদানি ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ পুরোপুরি বন্ধ করার কথা। তবে, কিছু ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়ার মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য কিছু ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কারণ এই দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাসের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। এছাড়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের মতো কিছু দেশ এখনও রাশিয়ার গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছে।
বর্তমানে ইইউ-এর মোট আমদানিকৃত গ্যাসের প্রায় ১৩% আসে রাশিয়া থেকে, এবং তেলের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৩%। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে রাশিয়া তাদের জ্বালানি সরবরাহকে অন্যান্য বাজারের দিকে সরিয়ে দেবে। বর্তমানে রাশিয়ার জ্বালানির প্রধান ক্রেতা হিসেবে চীন, ভারত এবং তুরস্কের নাম উঠে এসেছে।
এই পরিকল্পনাটি 'রিপাওয়ারইইউ' (RepowerEU) উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জ্বালানি উৎসের বহুমুখীকরণ, শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির দ্রুত বিকাশ। ইউরোপীয় জ্বালানি কমিশনার ড্যান জর্গেনসেন এই সিদ্ধান্তের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, "এটি বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ—ইইউ একটি একক সরবরাহকারীর উপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে।"
আলোচনায় অংশগ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে ডেনমার্কের জ্বালানি মন্ত্রী লার্স আয়াগার্ড এই পরিকল্পনাকে "ইউরোপের জ্বালানি স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য" বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো তার দেশের জন্য জ্বালানি সরবরাহের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এই পরিকল্পনাটি অনুমোদনের জন্য ইইউ কাউন্সিল কোয়ালিফাইড মেজরিটি (Qualified Majority) পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কমপক্ষে ৫৫% ভোটের প্রয়োজন ছিল। এই পদ্ধতির কারণে হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়া চাইলেও সিদ্ধান্তটি আটকে দিতে পারেনি। একইসঙ্গে, ইইউ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ প্রস্তুত করছে, যার মধ্যে ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ব্লকটি আগামী তিন বছরের জন্য ৭৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এলএনজি সরবরাহের চুক্তিসহ জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করছে।
এই পরিকল্পনাটি এখনও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান বিবেচনা করে চূড়ান্ত নিয়মাবলীতে কিছু পরিবর্তন বা সমন্বয় করা হতে পারে, যা এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।