আফগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তালেবানের ৬৭৯টি বই অপসারণ: মতাদর্শিক শুদ্ধিকরণ ও জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা
সম্পাদনা করেছেন: Tatyana Hurynovich
আফগানিস্তানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তালেবান সরকার কর্তৃক ৬৭৯টি বই অপসারণের নির্দেশ দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় এক গভীর মতাদর্শিক শুদ্ধিকরণ এবং জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইন, সমাজবিজ্ঞান, শরিয়া, সাংবাদিকতা, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত এই বইগুলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের পথকে সীমিত করছে এবং দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশকে সংকীর্ণ করে তুলছে। এই পদক্ষেপটি তালেবানের পূর্ববর্তী শাসনের সময়কার শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা জ্ঞান ও তথ্যের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল।
তালেবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা এই নির্দেশনায় শরিয়া, হানাফি ফিকহ এবং দেশের মতাদর্শিক ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত বইগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগান আইনের মৌলিক বিষয়াবলী, নারীর অধিকার, গণতন্ত্রের ধারণা, জনসম্পর্কে নারীর ভূমিকা, ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলী, নীতিশাস্ত্র এবং পাপ ও অনৈতিকতার কারণ সম্পর্কিত আলোচনা। শুধু তাই নয়, বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের কাজ, যেমন দান্তে আলিঘিয়েরির 'ডিভাইন কমেডি', খলিল জিবরানের 'দ্য প্রফেট', এবং ইউভাল নোয়াহ হারারির 'সেপিয়েন্স'-এর মতো বইগুলোকেও 'বিচ্যুত' আখ্যা দিয়ে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অপসারণের মূল কারণ হিসেবে তালেবান নেতারা বইগুলোর বিষয়বস্তুকে "ইসলাম-বিরোধী", "জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী" এবং "সমাজকে বিপথগামী ও কলুষিত করার উদ্দেশ্যে রচিত" বলে দাবি করছেন। এই তালিকায় রাজনৈতিক তত্ত্ব, দর্শন, আইন এবং সামাজিক বিষয়াবলী সম্পর্কিত বইগুলোও বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
এই বই অপসারণের ঘটনাটি আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানোর বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ। তালেবান নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষ কমিশন, যেখানে মূলত ধর্মীয় আলেম এবং তালেবান মতাদর্শের অনুসারীরা রয়েছেন, তারা ১৮টি বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েছে এবং আরও ২০১টি বিষয়কে "সমস্যাযুক্ত" হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোর সংশোধন ও বিকল্প বিষয় সংযোজনের নির্দেশ দিয়েছে। পূর্ববর্তী সরকারের শিক্ষাব্যবস্থাকে "পশ্চিমা দেশগুলোর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন" হিসেবে আখ্যায়িত করে তালেবানরা তাদের নিজস্ব মতাদর্শিক কাঠামোতে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে চাইছে। এই প্রবণতা ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান শাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজবিজ্ঞানের অনেক বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে 'ইসলামিকরণ' করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এই নতুন পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় অধ্যয়নের জন্য পূর্বের ৮ ক্রেডিটের পরিবর্তে ২৪ ক্রেডিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা অন্যান্য বিষয়ের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি, মানবাধিকার, নারীর অধ্যয়ন, সামাজিক কল্যাণ এবং এমনকি যুদ্ধ বিষয়ক সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য "অপূরণীয় ক্ষতি" বয়ে আনবে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ফিয়াজুল্লাহ জালালের মতে, এই পদক্ষেপ "আফগানিস্তানের শিক্ষার্থীদের একশ বছর পিছিয়ে দেবে"। জ্ঞান ও তথ্যের অবাধ প্রবাহকে রুদ্ধ করার এই প্রচেষ্টা শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটি একটি "হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম" তৈরি করতে পারে, যারা বিশ্বমানের জ্ঞান ও ধারণা থেকে বঞ্চিত হবে। তালেবানদের এই নীতি কেবল শিক্ষাগত বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজে তাদের মতাদর্শিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল। তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে "মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কারখানায়" পরিণত করতে চাইছে, যেখানে কেবল তাদের অনুমোদিত জ্ঞানই প্রচারিত হবে। শুধু তাই নয়, সুন্নি হানাফি ফিকহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন ধর্মীয় বই, যেমন শিয়া, হিজবুত তাহরীর এবং সালাফিস্টদের লেখা বইগুলোও অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের অসহিষ্ণুতারও প্রতিফলন। আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ৬৭৯টি বই অপসারণের এই ঘটনাটি দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার উপর তালেবান শাসনের গভীর প্রভাবের একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। মতাদর্শিক শুদ্ধিকরণ এবং জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের এই প্রচেষ্টা আফগানিস্তানের তরুণ প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং দেশের সামগ্রিক সামাজিক অগ্রগতির পথে এক বিরাট বাধা সৃষ্টি করবে। এটি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে মুক্তচিন্তা ও অনুসন্ধিৎসা কেবল সীমিতই নয়, বরং নিষিদ্ধও বটে। এই পদক্ষেপগুলো আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে জ্ঞানার্জন একটি নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবদ্ধ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে, যা জীবনের গভীরতর সত্য অনুসন্ধানের পথকে আরও দুর্গম করে তোলে।
উৎসসমূহ
Deutsche Welle
روزنامه ۸صبح
BBC News فارسی
روزنامه ۸صبح
এই বিষয়ে আরও খবর পড়ুন:
আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?
আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।
