আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনাপূর্ণ এক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ইউক্রেনের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার শর্তাবলী বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। এই শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (UNSC) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভ করা, তবে ন্যাটো (NATO) সদস্যপদ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে রাশিয়া স্পষ্ট করেছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার উপর সম্ভাব্য কঠোর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করছেন, যা এই সংঘাতের সমাধানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উত্থাপিত শর্তাবলী বেশ সুনির্দিষ্ট। লাভরভ জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে অবশ্যই কোনো সামরিক জোটের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এই নিরপেক্ষতার বিনিময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীন, পাশাপাশি জার্মানি ও তুরস্কের মতো দেশগুলো ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদান করবে। তবে, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা রাশিয়ার জন্য একটি 'রেড লাইন' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এই বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। অতীতে, ২০২২ সালের ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনায় এই ধরনের একটি নিরপেক্ষতার ধারণা আলোচিত হয়েছিল, যেখানে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের প্রস্তাব পেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার ভূমিকার উপর নির্ভরতা এবং অন্যান্য কিছু কারণে সেই আলোচনা চূড়ান্ত রূপ পায়নি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একটি সরাসরি শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। লাভরভ জানিয়েছেন যে, পুতিন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত, তবে একটি সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি প্রস্তুত থাকা আবশ্যক, যা বর্তমানে একেবারেই তৈরি নয়। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার এবং একটি শীর্ষ বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ পশ্চিমা দেশগুলোকে শান্তি আলোচনায় বাধা দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন এবং জেলেনস্কির উপর শর্ত আরোপের জন্য চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগ এনেছেন। এই অচলাবস্থা উভয় পক্ষের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য এবং পারস্পরিক আস্থার অভাবকেই নির্দেশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সংঘাতের সমাধানে নিজের সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা করছেন। তিনি রাশিয়ার উপর 'ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা' বা 'ব্যাপক শুল্ক' আরোপের হুমকি দিয়েছেন, যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ইউক্রেনে অবস্থিত একটি মার্কিন কারখানায় রাশিয়ার হামলার ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, যেখানে কিছু কর্মী আহত হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিকে তিনি 'খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং এটি রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার উত্থাপিত শর্তাবলী, বিশেষ করে ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা এবং ন্যাটো বর্জনের বিষয়টি, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। র্যান্ড কর্পোরেশনের স্যামুয়েল চারাপের মতো বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার শান্তি আলোচনার প্রতি 'উন্মুক্ততা' আসলে ট্রাম্পের জন্য একটি প্রদর্শনী হতে পারে, প্রকৃত সমঝোতার লক্ষণ নয়। সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনও মনে করেন যে, এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক থেকে তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল আশা করা যায় না, কারণ পুতিন আলোচনা দীর্ঘায়িত করার কৌশল অবলম্বন করছেন। এই জটিল পরিস্থিতিতে, ইউক্রেন তার মিত্রদের কাছ থেকে শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আদায়ের চেষ্টা করছে, যা ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তি চুক্তির জন্য অপরিহার্য। এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যাশা সংঘাতের একটি স্থায়ী সমাধানের পথকে আরও কঠিন করে তুলেছে।