ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কোসুর (আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়ের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য জোট) একটি যুগান্তকারী মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। ডিসেম্বর ২০২৪-এ স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল তৈরি করেছে, যা ৭০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে। ২৫ বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর সম্পন্ন হওয়া এই চুক্তিটি বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্ক ও বাণিজ্য বাধা দূর করা হবে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। ইউরোপীয় কমিশন অনুমান করছে যে এই চুক্তিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানি ৩৯% বৃদ্ধি করবে, যা প্রায় ৪৯ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছাবে এবং ইউরোপ জুড়ে ৪৪০,০০০ এর বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। এই চুক্তির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিল্পপণ্য, যেমন গাড়ি, যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে এই পণ্যগুলির উপর ৩৫% পর্যন্ত শুল্ক প্রযোজ্য।
চুক্তিটি পরিবেশ সুরক্ষার উপরও জোর দিয়েছে, যার মধ্যে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং বিপন্ন প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী কনভেনশন (CITES) কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উভয় পক্ষই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নিজস্ব আইন প্রণয়নের অধিকার বজায় রাখবে।
তবে, এই চুক্তিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সদস্য রাষ্ট্র, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। এই দেশগুলোর কৃষকরা মনে করেন যে মার্কোসুর থেকে সস্তা কৃষি পণ্যের আমদানি তাদের স্থানীয় বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায়, ইউরোপীয় কমিশন একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছে যা নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পেলে বা দাম কমে গেলে শুল্ক হ্রাস সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুমতি দেবে। এই পদক্ষেপটি সমালোচকদের উদ্বেগ প্রশমিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিকভাবে, এই চুক্তিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি কৌশলগত বার্তা বহন করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতির বিপরীতে মুক্ত ও ন্যায্য বাণিজ্যের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে। এই চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মোকাবেলায় সহায়ক হবে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীনের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বাড়াতেও সাহায্য করবে।
এই চুক্তিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। যদিও কিছু সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, তবে এই চুক্তিটি বিশ্ব বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।