দক্ষিণ আমেরিকা বর্তমানে বিশ্ব মঞ্চে পরিচ্ছন্ন শক্তির এক নতুন পথিকৃৎ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ২০২৫ সালে এই অঞ্চলে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা এই অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটায়। এই অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির পেছনে সহায়ক নীতি এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির আকর্ষণ একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া এবং কোস্টারিকার মতো দেশগুলো এই অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশেষত, ব্রাজিলের ২০২৪ সালে কার্যকর হওয়া 'ফিউচার ফুয়েল ল' (Future Fuel Law) ক্ষুদ্র আকারের সৌর ফটোভোলটাইক (PV) এবং বায়োএনার্জি প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে। এই নীতিগত পদক্ষেপগুলি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে, যা এই অঞ্চলের শক্তি রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করছে। চিলি, যা সৌর শক্তির জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়, তার বিশাল সৌর বিকিরণকে কাজে লাগিয়ে ফটোভোলটাইক শক্তির উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। চিলির সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের বিদ্যুতের ৬০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
এই বিনিয়োগের ঢেউ কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। চরম আবহাওয়ার কারণে অবকাঠামোগত চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায়, শক্তি সঞ্চয় (storage) এবং গ্রিড ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তঃসীমান্ত সংযোগ স্থাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। সামগ্রিকভাবে, ২০৩৪ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় ১৬০ গিগাওয়াট (GW) সৌর পিভি ক্ষমতা যুক্ত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যার মধ্যে ব্রাজিল এবং চিলি সম্মিলিতভাবে এই অঞ্চলের মোট সৌর পিভি স্থাপনার ৭৮% অবদান রাখবে।
এই রূপান্তর কেবল পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন পথও উন্মোচন করছে। আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা (IRENA) জানিয়েছে যে, এই রূপান্তর সফল হলে ২০২৩ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বার্ষিক অতিরিক্ত ১.১% বৃদ্ধি পেতে পারে এবং শক্তি খাতে ১২ মিলিয়নেরও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। যদিও বর্তমানে এই অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিমাণ বিশ্বব্যাপী মোট বিনিয়োগের মাত্র ২.৫% (২০২৪ সালে ৫৮ বিলিয়ন ডলার), ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বিশাল। এই অগ্রগতি প্রমাণ করে যে, সঠিক নীতি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব, যেখানে শক্তির উৎসগুলি প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
তবে, এই বিশাল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অবকাঠামো এবং সঞ্চয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও মনোযোগ দিতে হবে। এই অঞ্চলে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশকে আরও বেগবান করতে হলে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবাহকে আরও সহজলভ্য করা এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা অপরিহার্য। এই পদক্ষেপগুলি নিশ্চিত করবে যে, দক্ষিণ আমেরিকা কেবল বর্তমানের চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী ও স্থিতিস্থাপক শক্তি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।
