প্রযুক্তি জগতে এক বিশাল অগ্রগতির ঘোষণা দিয়েছে অ্যালফাবেট কর্পোরেশন। তাদের অধীনস্থ গুগল কোয়ান্টাম এআই (Google Quantum AI) বিভাগটি তাদের নতুন কোয়ান্টাম প্রসেসর 'উইলো' (Willow)-তে 'কোয়ান্টাম ইকোস' (Quantum Echoes) নামক অ্যালগরিদমটি সফলভাবে তৈরি ও বাস্তবায়ন করেছে। ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন একটি কোয়ান্টাম গণনা সম্পন্ন হলো যা প্রচলিত সুপারকম্পিউটারগুলোর চেয়ে দ্রুততর, এবং একই সাথে এর ফলাফল অন্যান্য কোয়ান্টাম যন্ত্রপাতিতে যাচাই ও পুনরুৎপাদন করা সম্ভব।
এই যুগান্তকারী অর্জনের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ২৫ সালের ২১ অক্টোবর নেচার (Nature) জার্নালে। 'উইলো' চিপে চালিত 'কোয়ান্টাম ইকোস' অ্যালগরিদমটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটার 'ফ্রন্টিয়ার' (Frontier)-এর তুলনায় প্রায় ১৩,০০০ গুণ বেশি দ্রুততা প্রদর্শন করেছে। এটি ব্যবহারিক কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পথে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর অর্থ হলো, যে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করতে ক্লাসিক্যাল মেশিনগুলোর হাজার হাজার বছর লাগতো, সেই একই কাজ এখন এই কোয়ান্টাম ডিভাইসটিতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব।
এই অ্যালগরিদমের মূল ভাবনাটি হলো “কোয়ান্টাম ইকো” নামক একটি বিশেষ ঘটনাকে কাজে লাগানো—যা কোয়ান্টাম বিটগুলোর ওপর ধারাবাহিক অপারেশন চালানোর ফলে সৃষ্ট জটিল ইন্টারফারেন্স প্রভাব। এই প্রভাবগুলো পরবর্তীতে বিপরীতভাবে পুনর্নির্মাণ করা যায়। এই অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে অণু, চৌম্বকীয় পদার্থ অথবা কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাক হোল) মতো জটিল সিস্টেমগুলোর আচরণ অত্যন্ত নির্ভুলতার সাথে অধ্যয়ন করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এই ফলাফলগুলো অন্য যেকোনো কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা প্রাকৃতিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা যেতে পারে।
আন্তঃআণবিক দূরত্ব এবং কাঠামোর মডেলিংয়ের ক্ষেত্রে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি নতুন ওষুধ, উন্নত উপকরণ এবং প্রযুক্তির বিকাশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই সক্ষমতা রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
পরীক্ষার সময়, গবেষকরা সফলভাবে ১৫ এবং ২৮টি পরমাণুযুক্ত সিস্টেমের কাঠামো গণনা করতে সক্ষম হন। এই ধরনের জটিল আণবিক কাঠামো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন দরজা খুলে দিয়েছে, যা বর্তমানে এই ক্ষেত্রগুলোতে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
গুগল কোয়ান্টাম এআই দলের প্রধান বিজ্ঞানী, যিনি ২৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, সেই মিশেল ডেভোরে (Michel Devoret) এই সাফল্যের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই অর্জন কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ব্যবহারিক ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
গুগল কোয়ান্টাম এআই-এর অন্যতম প্রধান গবেষক টম ও’ব্রায়েন (Tom O’Brien) মন্তব্য করেছেন যে, ফলাফল যাচাই এবং পুনরুৎপাদন করার ক্ষমতা বিজ্ঞান ও শিল্পে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের আরও বাস্তবায়নের জন্য একটি মূল চালিকাশক্তি। এই বৈশিষ্ট্যটিই কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে আরও মজবুত করে।
আজকের এই সাফল্য বাস্তব বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৌশলগত সমস্যা সমাধানের উপযোগী ডিভাইস তৈরির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো কেবল তাত্ত্বিক অগ্রগতি হিসেবেই নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি নিশ্চিত করে যে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির 'ব্লু এজ' (Blue Age) বা নীল যুগ শুরু হয়ে গেছে, এবং আগামী বছরগুলোতে মানবজাতির সামনে এমন সব নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে, যা আগে অসাধ্য বলে মনে করা হতো।
