প্রযুক্তি জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়ার একদল প্রকৌশলী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন, যেখানে তারা প্রচলিত ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP) ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কে কোয়ান্টাম সিগন্যাল প্রেরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই যুগান্তকারী গবেষণাটি বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি একটি ‘কোয়ান্টাম ইন্টারনেট’-এর ভবিষ্যতের পথ খুলে দিয়েছে, যেখানে কোয়ান্টাম ডেটা এবং প্রচলিত ডেটা একই পরিকাঠামোয় চলতে পারবে। এই পরীক্ষাটি ফিলাডেলফিয়ার ভেরাইজন (Verizon)-এর ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকৌশলীদের তৈরি ‘কিউ-চিপ’ (Q-Chip) নামক একটি বিশেষ সিলিকন চিপ কোয়ান্টাম এবং ক্লাসিক্যাল ডেটা সমন্বয়ের কাজটি করে। এটি ৯৭%-এর বেশি ট্রান্সমিশন বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে এবং বর্তমান ইন্টারনেটের মতোই প্রোটোকল ব্যবহার করে। এই উদ্ভাবনটি কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে অতি-সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ঔষধ আবিষ্কারের মতো অত্যাধুনিক অ্যাপ্লিকেশনগুলির জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
কোয়ান্টাম সিগন্যালগুলি ‘এন্টাঙ্গলড’ (entangled) কণা জোড়ার উপর নির্ভর করে, যা একে অপরের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত থাকে যে একটির পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে অন্যটিকে প্রভাবিত করে। এই বৈশিষ্ট্যটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলিকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে তাদের সম্মিলিত প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে দ্রুততর, আরও শক্তি-সাশ্রয়ী AI বা আজকের সুপারকম্পিউটারের নাগালের বাইরের নতুন ঔষধ ও উপকরণের নকশা তৈরি সম্ভব হবে।
পেনসিলভেনিয়ার এই গবেষণাটি সরাসরি বাণিজ্যিক ফাইবারের উপর প্রথমবার দেখিয়েছে যে, একটি চিপ কেবল কোয়ান্টাম সিগন্যাল পাঠাতেই পারে না, বরং এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নয়েজ (noise) সংশোধন করতে, কোয়ান্টাম ও ক্লাসিক্যাল ডেটাকে ইন্টারনেট-শৈলীর প্যাকেটে বান্ডিল করতে এবং সাধারণ ইন্টারনেট ঠিকানা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেগুলিকে রুট করতে পারে। এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা অপরিসীম। কোয়ান্টাম ইন্টারনেট ডেটা সুরক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে।
তবে, এই প্রযুক্তির বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কোয়ান্টাম সিগন্যালের জন্য প্রয়োজনীয় ‘কিউবিট’ (qubit)-এর সংবেদনশীলতা এবং দীর্ঘ দূরত্বে তাদের ‘এন্টাঙ্গলমেন্ট’ (entanglement) বজায় রাখা একটি বড় বাধা। ‘ডিকোহেরেন্স’ (decoherence) বা পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে কোয়ান্টাম অবস্থার পরিবর্তন রোধ করতে ‘কোয়ান্টাম রিপিটার’-এর মতো নতুন ডিভাইসের প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য গবেষকরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।
ভেরাইজনের মতো সংস্থাগুলি তাদের ফাইবার নেটওয়ার্কের কোর আপগ্রেড করে ৪00 জিবিপিএস (Gbps) পর্যন্ত অপটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা ডেটা পরিবহনের ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়েছে। এই পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কোয়ান্টাম প্রযুক্তির প্রসারের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করছে। এই অগ্রগতিগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি যেখানে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও অঙ্গীভূত হবে, যা যোগাযোগ, গণনা এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনবে। এই উদ্ভাবনটি কেবল একটি পরীক্ষামূলক সাফল্য নয়, বরং এটি একটি প্রমাণ যে কোয়ান্টাম ডেটা বর্তমান ইন্টারনেট ব্যবস্থার সাথে সফলভাবে একত্রিত হতে পারে এবং ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী সংযোগের একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারে।