বিজ্ঞান জগতে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের SLAC ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরি, তারা অপ্রত্যাশিতভাবে এক নতুন যৌগ – গোল্ড হাইড্রাইড (gold hydride) – সংশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সোনা রাসায়নিকভাবে অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় ও সাধারণ বলে পরিচিত হলেও, চরম চাপ ও তাপমাত্রার অধীনে এর এই নতুন রূপ উন্মোচিত হয়েছে, যা গ্রহ ও নক্ষত্রের অভ্যন্তরের রহস্য এবং মহাজাগতিক পারমাণবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
গবেষণাটি মূলত হাইড্রোকার্বন কীভাবে চরম চাপ ও তাপে হীরার মতো পদার্থে রূপান্তরিত হয়, তা নিয়ে শুরু হয়েছিল। জার্মানির ইউরোপীয় XFEL (X-ray Free-Electron Laser) নামক একটি এক্স-রে লেজার সুবিধায়, গবেষকরা হাইড্রোকার্বন নমুনার উপর একটি পাতলা সোনার প্রলেপ ব্যবহার করেছিলেন। সোনার উদ্দেশ্য ছিল কেবল এক্স-রে শোষণ করা এবং তাপ পরিবাহিত করা। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে, হীরা তৈরির পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা গোল্ড হাইড্রাইডের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। SLAC-এর গবেষক এবং এই গবেষণার প্রধান লেখক মুঙ্গো ফ্রস্ট বলেন, "এটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল কারণ সোনা সাধারণত রাসায়নিকভাবে প্রায় অ-প্রতিক্রিয়াশীল। ঠিক এই কারণেই আমরা এটিকে এক্স-রে শোষক হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম।"
এই আবিষ্কারটি প্রমাণ করে যে চরম পরিস্থিতিতে রাসায়নিক আচরণ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যা পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তর বা নক্ষত্রের ভেতরের অবস্থার অনুরূপ। গবেষকরা ডায়মন্ড অ্যানভিল সেল (diamond anvil cell) ব্যবহার করে হাইড্রোকার্বন নমুনাগুলিকে পৃথিবীর ম্যান্টলের চেয়েও বেশি চাপে সংকুচিত করেন এবং এক্স-রে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেগুলিকে ১,৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (প্রায় ৩,৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উপরে উত্তপ্ত করেন। এই চরম পরিস্থিতিতে, কার্বন পরমাণুগুলি হীরার মতো একটি ল্যাটিসে সজ্জিত হয়। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি সোনার সাথে বিক্রিয়া করে গোল্ড হাইড্রাইড গঠন করে। এই অবস্থায়, হাইড্রোজেন একটি 'সুপারআয়োনিক' (superionic) দশায় প্রবেশ করে, যেখানে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি সোনার অনমনীয় ল্যাটিসের মধ্যে অবাধে চলাচল করতে পারে। এই ঘটনা গোল্ড হাইড্রাইডের পরিবাহিতা বৃদ্ধি করে এবং চরম চাপ ও তাপমাত্রায় পদার্থের আচরণ সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
মুঙ্গো ফ্রস্ট ব্যাখ্যা করেছেন, "আমরা সোনার ল্যাটিসকে একটি 'সাক্ষী' হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, যা হাইড্রোজেনের আচরণ দেখতে সাহায্য করে।" এই আবিষ্কারের তাৎপর্য্য অনেক। এটি বৃহস্পতির মতো বিশাল গ্রহগুলির অভ্যন্তরীন গঠন বুঝতে সাহায্য করতে পারে, যেখানে কঠিন হাইড্রোজেন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, এটি নক্ষত্রের অভ্যন্তরে পারমাণবিক ফিউশন (nuclear fusion) প্রক্রিয়া সম্পর্কেও আলোকপাত করে। এই পরীক্ষাটি যেন আমাদের ভিন্ন মহাজাগতিক জগৎ এবং প্রাকৃতিক মহাজাগতিক চুল্লিগুলির একটি ঝলক দেখায়। গবেষণাটি প্রায় ৪০ গিগাপ্যাসকেল (GPa) এর বেশি চাপ এবং ২,২০০ কেলভিন (প্রায় ২,২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় সম্পন্ন হয়েছিল, যেখানে হাইড্রোজেনের সুপারআয়োনিক অবস্থা সোনার ল্যাটিসের মধ্যে বিশৃঙ্খলভাবে মিশে থাকে। এই নতুন যৌগটির রাসায়নিক সংকেত Au₂Hₓ (Au₂Hₓ) বলে জানা গেছে।
এই আবিষ্কারটি কেবল গ্রহ বিজ্ঞান এবং শক্তি গবেষণার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং রাসায়নিক জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করার ক্ষেত্রেও এটি একটি বড় পদক্ষেপ। দীর্ঘকাল ধরে প্রায় নিষ্ক্রিয় বলে বিবেচিত সোনা, চরম চাপ ও তাপমাত্রার অধীনেও একটি স্থিতিশীল হাইড্রাইড গঠন করতে পারে, যা পূর্বে কেবল তত্ত্বের মাধ্যমে অনুমান করা যেত। এই গবেষণাটি প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান প্রায়শই অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের মাধ্যমে অগ্রগতি লাভ করে। কে ভেবেছিল যে সোনা, তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য পরিচিত, মহাবিশ্বের রসায়নের এক নতুন দিগন্তের প্রবেশদ্বার হতে পারে?
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন SLAC-এর ডিরেক্টর সিগফ্রিড গ্লেনজার (Siegfried Glenzer), যিনি উচ্চ-শক্তি-ঘনত্বের পদার্থবিদ্যা এবং ফিউশন শক্তি গবেষণায় একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতে, "এই ধরনের পদার্থের অবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি এবং মডেলিং করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সিমুলেশন সরঞ্জামগুলি অন্যান্য উপকরণের চরম পরিস্থিতিতে তাদের বহিরাগত বৈশিষ্ট্যগুলি মডেল করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।" এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি মহাকাশ বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের বিভিন্ন শাখায় নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে।