আর্মেনিয়ার উচ্চভূমি জুড়ে বিস্তৃত রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক মনোলিথ, যা 'ভিশাপ' বা 'ড্রাগন স্টোন' নামে পরিচিত, সেগুলির কার্যকারিতা ও ধর্মীয় তাৎপর্য নিয়ে নতুন গবেষণা এক যুগান্তকারী আলোকপাত করেছে। ইয়েরেভান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের দ্বারা, ভাহে গুরাডিয়ান এবং আর্সেন বোবোখিয়ানের নেতৃত্বে, পরিচালিত এই গবেষণা, যা ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে হেরিটেজ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, এই বিশাল পাথরগুলির (৩ থেকে ১৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু) অবস্থান বিশ্লেষণ করে এদের প্রাচীন জল-কেন্দ্রিক ধর্মীয় আচারে ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে।
এই গবেষণা, যার শিরোনাম 'ভিশাপ স্টিলি যেমন কাল্ট ডেডিকেটেড প্রিহিস্টোরিক মনুমেন্টস অফ আর্মেনিয়ান হাইল্যান্ডস: ডেটা অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইন্টারপ্রিটেশন', ১১৫টি ভিশাপের একটি বিস্তৃত পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করেছে। এর থেকে জানা যায় যে এই পাথরগুলি কেবল এলোমেলোভাবে স্থাপন করা হয়নি, বরং এগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে এবং প্রচুর শ্রমের বিনিময়ে জলধারা, ঝর্ণা এবং প্রাচীন সেচ ব্যবস্থার কাছাকাছি উচ্চ-উচ্চতায় স্থাপন করা হয়েছিল। এটি এই ধারণাটিকে শক্তিশালী করে যে এগুলি জলকে জীবনদায়ী শক্তি হিসেবে উপাসনা করার একটি প্রাচীন জল-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির অংশ ছিল।
বিশেষ করে, মাছের মতো আকৃতির ভিশাপগুলি প্রায় ২৭০০ মিটার (৮৮৬০ ফুট) উচ্চতায় বেশি দেখা যায়, যা জল উৎসের কাছাকাছি অবস্থিত। অন্যদিকে, গরুর চামড়ার মতো আকৃতির ভিশাপগুলি মাঝারি উচ্চতায় পাওয়া যায়, যেখানে জল মানুষের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য ছিল। এই বিন্যাসটি প্রাচীন সেচ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা প্রায় এক শতাব্দী আগে পণ্ডিত আশখারবেখ কালান্তার কর্তৃক প্রস্তাবিত তত্ত্বকে সমর্থন করে।
রেডিওকার্বন ডেটিং অনুসারে, মাউন্ট আরাগাটসের তিরিনকাটার সাইটের ভিশাপগুলি প্রায় ৪২০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের, অর্থাৎ ক্যালকোলিথিক যুগের। এই সময়কালটি স্টোনহেঞ্জ এবং গোবেকলি টেপের মতো অন্যান্য বিশ্ব-বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভের প্রথম নির্মাণ পর্বের সমসাময়িক। সময়ের সাথে সাথে, এই স্থানগুলিতে অন্যান্য প্রত্নবস্তু যেমন পেট্রোগ্লিফ, কায়ার্ন এবং ক্রোমলিখ যুক্ত হয়েছে, যা তাদের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের প্রমাণ দেয়। এমনকি ৯ম থেকে ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের উরার্তিয়ান যুগেও এই পাথরগুলিতে শিলালিপি যুক্ত করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় আর্মেনীয় লিপিতেও এদের ব্যবহার দেখা যায়, যা তাদের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে।
এই গবেষণা কেবল ভিশাপগুলির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা উন্মোচন করেনি, বরং এটি আর্মেনিয়ার প্রাগৈতিহাসিক সমাজের উন্নত পরিকল্পনা ক্ষমতা এবং জলকে কেন্দ্র করে জটিল ধর্মীয় বিশ্বাসকেও তুলে ধরেছে। এই বিশাল পাথরগুলির উৎস, খোদাই এবং পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম ছিল অত্যন্ত কঠিন, যা প্রায়শই ৪ টনের বেশি ওজনের হত। এই প্রচেষ্টাগুলি প্রমাণ করে যে প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলি জলকে কেবল একটি ব্যবহারিক সম্পদ হিসেবেই নয়, বরং একটি পবিত্র শক্তি হিসেবেও বিবেচনা করত, যা তাদের জীবন ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভগুলির সংরক্ষণ আমাদের প্রাচীন ইউরোপীয় আধ্যাত্মিক রীতিনীতি এবং জলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে।