মোয়াই মূর্তি স্থানান্তরের রহস্য উন্মোচন: রাপা-নুই-এর মূর্তিগুলি উল্লম্বভাবে 'হেঁটে যেত'
সম্পাদনা করেছেন: Ирина iryna_blgka blgka
পৃথিবীর অন্যতম বিচ্ছিন্ন স্থান রাপা-নুই (ইস্টার দ্বীপ)-এর বিশাল মোয়াই পাথরের মূর্তিগুলি কীভাবে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তা বহু দশক ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে বিস্ময় ও কৌতূহলের বিষয় ছিল। প্রায় ১০ মিটার উচ্চতা এবং ৭০ টন পর্যন্ত ওজনবিশিষ্ট এই মনোলিথগুলি দ্বীপের প্রাচীন বাসিন্দারা কোনো ধাতু বা চাকা ব্যবহার না করেই তৈরি করেছিলেন। সম্প্রতি, ২০২৫ সালে জার্নাল অফ আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি যুগান্তকারী গবেষণা সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ উপস্থাপন করেছে যে মূর্তিগুলি আসলে উল্লম্বভাবে 'হেঁটে' যেতে পারত—যা সম্ভব হয়েছিল সুচিন্তিত প্রকৌশলগত আকৃতি এবং দোলকীয় গতিবিদ্যার (pendulum dynamics) নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে।
বিংহামটন ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী কার্ল লিপো এবং অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির তাঁর সহকর্মী টেরি হান্ট-এর নেতৃত্বে গঠিত দলটি 'হাঁটা' মোয়াই সম্পর্কিত পুরোনো অনুমানটি যাচাই করার জন্য ডিজিটাল মডেলিং, ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার আশ্রয় নেন। গবেষকরা প্রায় ৯৬২টি পরিচিত মূর্তি বিশ্লেষণ করেন, যার মধ্যে ৬২টি মূর্তি ছিল রানো রারাকু খনি থেকে প্রাচীন রাস্তা ধরে স্থাপন করা।
এই তথাকথিত 'রাস্তার মোয়াই'গুলির মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়—যেমন চওড়া 'D' আকৃতির ভিত্তি এবং সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা দেহ। এই ধরনের নকশা মূর্তির ভরকেন্দ্রকে স্থানান্তরিত করে দিত এবং এটিকে স্থিতিশীলভাবে একপাশ থেকে অন্যপাশে দুলতে সাহায্য করত, যা অনেকটা হাঁটার পদক্ষেপের মতো দেখাত।
এই মডেলটি পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা মূল মূর্তিগুলির অনুপাত বজায় রেখে ৪.৩৫ টন ওজনের একটি পূর্ণ আকারের মোয়াই প্রতিরূপ তৈরি করেন। তিনটি লম্বা দড়ি এবং ১৮ জন মানুষের একটি দলের সহায়তায়, তারা মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে প্রতিরূপটিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত সরাতে সক্ষম হন। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে, যখন উভয় দিক থেকে দড়ি ধরে থাকা লোকেরা পর্যায়ক্রমে টান দিত, তখন নিয়ন্ত্রিত দোলনের মাধ্যমে মূর্তিটি উল্লম্ব অবস্থানে থেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারত।
এই পদ্ধতিটি কেবল সম্ভবই ছিল না, বরং এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ীও প্রমাণিত হয়। ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বগুলিতে যেমন কাঠ বা স্লেজ ব্যবহার করে মূর্তি টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তার তুলনায় এই 'হাঁটা' পদ্ধতিতে অনেক কম সংখ্যক মানুষ এবং সম্পদের প্রয়োজন হয়েছিল।
নতুন গবেষণার অংশ হিসেবে পরিচালিত ভার্চুয়াল মডেলিং বিভিন্ন আকারের মূর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গণনা করতে সক্ষম হয়। দেখা যায় যে, আন্দোলন শুরু করার জন্য প্রায় ১৫ জন লোকই যথেষ্ট ছিল এবং ছোট দলও হাঁটার গতি বজায় রাখতে পারত। এই 'হাঁটা' মোয়াইগুলির গড় গতি ছিল প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৩০০ মিটার এবং প্রতিটি পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৯০ সেমি। আশ্চর্যজনকভাবে, বড় মূর্তিগুলি ধীরে চলত না; বরং তাদের ভর এবং জড়তার কারণে তারা আরও দীর্ঘ পদক্ষেপ নিতে পারত।
এই ফলাফলগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সাথে তুলনা করে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। অনেক অসম্পূর্ণ বা পড়ে থাকা মোয়াই খনি থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যায়, যা ইঙ্গিত দেয় যে এগুলি সম্ভবত পরিবহণের ব্যর্থ চেষ্টার পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল—আগের মতো ধর্মীয় কারণ বা সম্পদের অভাবের জন্য নয়। যে প্রাচীন রাস্তাগুলি দিয়ে মূর্তিগুলি সরানো হয়েছিল, সেগুলির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবতল আকৃতি এবং গড় প্রস্থ ছিল প্রায় ৪.৫ মিটার। এই রাস্তাগুলি চলাচলের সময় মূর্তিগুলিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করত। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে রাস্তা এবং মূর্তিগুলি একটি সমন্বিত প্রকৌশল ব্যবস্থা হিসেবে তৈরি হয়েছিল, যেখানে নিরাপদ 'হাঁটা' স্থানান্তরের জন্য আকৃতি এবং ভূ-প্রকৃতি একে অপরের সাথে মানিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কার্ল লিপো এবং তাঁর সহকর্মীদের এই কাজটি প্রমাণ করে যে প্রাচীন রাপা-নুই কারিগরদের প্রতিভা জোর প্রয়োগে নয়, বরং প্রকৃতির নিয়মগুলিকে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করার মধ্যেই নিহিত ছিল। এই গবেষণাটি ভারসাম্য এবং পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি যৌক্তিক, সুষম প্রকৌশলের উদাহরণ দেখায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই নতুন তথ্যগুলি দ্বীপবাসীদের শত শত বছরের পুরোনো মৌখিক ঐতিহ্যের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়, যেখানে বলা হয়েছিল যে মোয়াই মূর্তিগুলি নিজেরাই তাদের গন্তব্যে 'এসেছিল'। বিজ্ঞান অবশেষে প্রমাণ করল—কীভাবে মোয়াই মূর্তিগুলি সত্যিই 'হেঁটেছিল' এবং প্রাচীন সমাজের প্রযুক্তিগত জ্ঞান কতটা উন্নত ছিল।
উৎসসমূহ
LaVanguardia
Scientific Reports
Ars Technica
এই বিষয়ে আরও খবর পড়ুন:
আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?
আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।
