স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র বাদুড়ই দীর্ঘস্থায়ী উড়ানের ক্ষমতা রাখে, যা বিজ্ঞানীদের কাছে এক গভীর আগ্রহের বিষয়। এই অনন্য ক্ষমতার উৎস সন্ধানে এক যুগান্তকারী গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, যা বিবর্তনীয় ধারণাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে। অক্টোবরের ২০২৫ সালে 'নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন' (Nature Ecology & Evolution) জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করে: বাদুড় উড়ানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কোনো জিন তৈরি করেনি; বরং তারা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে ভাগ করে নেওয়া বিদ্যমান জিনগুলিকেই নতুন করে কাজে লাগিয়েছে। এই জিনগত পুনর্ব্যবহারের ফলেই বাদুড় তাদের ডানা তৈরির জন্য বিশেষ অঙ্গসংস্থান এবং উড়ানের উপযোগী পেশী গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
ক্রিশ্চিয়ান ফেরেগ্রিনো (Christian Feregrino) নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণাটি নতুন কাঠামোর বিবর্তনীয় উদ্ভাবন সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে বিবর্তন কেবল নতুন জিন সৃষ্টির মাধ্যমে নয়, বরং বিদ্যমান জিনগত তথ্যকে পুনরায় ব্যবহার করার মাধ্যমেও নতুন কার্যকারিতা অর্জন করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে 'বিবর্তনীয় সহ-বিকল্প' (evolutionary co-option) বলা হয়, যেখানে পূর্ব-বিদ্যমান জিনগত নকশা নতুন প্রসঙ্গে নিয়োজিত হয়। গবেষকরা দেখেছেন যে বাদুড়ের ডানা গঠনে কোনো সম্পূর্ণ নতুন কোষের সৃষ্টি হয়নি; বরং মাউসের সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে কোষের প্রকারভেদ প্রায় একই রকম। মূল পার্থক্যটি নিহিত রয়েছে নিয়ন্ত্রক বিবর্তনে—অর্থাৎ, জিনগুলি কখন, কোথায় এবং কীভাবে সক্রিয় হবে তার পরিবর্তনে।
বাদুড়ের ডানার পাতলা চামড়া, যা কাইরোপটাজিয়াম (chiropatagium) নামে পরিচিত, তা গঠনে বিশেষ ধরনের ফাইব্রোব্লাস্ট কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই কোষগুলিতে MEIS2 এবং TBX3 নামক দুটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর সক্রিয় থাকে, যা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় থাকে। এই জিনগুলির কার্যকারিতা যাচাই করতে যখন মাউসের ভ্রূণে এগুলি প্রবেশ করানো হয়, তখন মাউসের আঙুলগুলি জালের মতো সংযুক্ত হয়ে প্রাথমিক বাদুড়ের ডানার মতো কাঠামো তৈরি করে। এই আবিষ্কারের একটি বৃহত্তর প্রভাব রয়েছে। এটি কেবল বাদুড়ের উড়ানের রহস্যই উন্মোচন করে না, বরং এটিও দেখায় যে কীভাবে সামান্য জিনগত পরিবর্তন বিশাল আকারগত উদ্ভাবন ঘটাতে পারে।
এই ধরনের জিনগত পুনর্বিন্যাস পাখি, তিমি এবং মাছের পাখনা বিবর্তনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। উপরন্তু, এই গবেষণা মানব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি সিন্ড্যাকটিলি (Syndactyly) বা আঙুল জোড়া লেগে থাকার মতো জন্মগত অঙ্গবিকৃতির সাথে সম্পর্কিত জিন নিয়ন্ত্রণের ত্রুটি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। বাদুড়েরা প্রায় ১৪০০ প্রজাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অ্যান্টার্কটিকা ব্যতীত প্রায় সব মহাদেশেই এদের পাওয়া যায়। বাস্তুতন্ত্রে তারা পরাগায়নকারী, বীজ বিস্তারকারী এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রক হিসেবে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতির এই বিস্ময়কর অভিযোজন ক্ষমতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি জীবের মধ্যেই অন্তর্নিহিতভাবে পরিবর্তনের ক্ষমতা নিহিত।