হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি যুগান্তকারী গবেষণা সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণাটি মানুষের দ্বিপদী চলন বা দুই পায়ে হাঁটার ক্ষমতা অর্জনের পিছনে দুটি মৌলিক বিবর্তনীয় পরিবর্তনের উপর আলোকপাত করেছে। গবেষকরা মানব এবং অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতির ভ্রূণ টিস্যুর নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন কিভাবে পেলভিস বা শ্রোণীচক্রের গঠন বিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে। এই গবেষণা মানব বিবর্তনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উন্মোচন করেছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের এক নতুন জীবনযাত্রার দিকে চালিত করেছিল।
গবেষণায় চিহ্নিত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি হলো ভ্রূণীয় বিকাশের সময় পেলভিসের বৃদ্ধি প্লেটের (growth plates) পুনঃবিন্যাস। এই পুনঃবিন্যাসের ফলে পেলভিসের উপরের অংশ, ইলিয়াম (ilium), লম্বা ও সরু আকৃতি থেকে প্রশস্ত ও বাঁকা আকার ধারণ করে। এই পরিবর্তনটি দ্বিপদী চলনের সময় ভারসাম্য রক্ষা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে, যা প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষকে একটি স্বতন্ত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে এবং দীর্ঘ দূরত্বে দক্ষতার সাথে চলার পথ প্রশস্ত করেছে।
দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তনটি হলো পেলভিসের অসিফিকেশন (ossification) বা হাড়ে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ার বিলম্ব। এই বিলম্বের ফলে বড় মস্তিষ্কযুক্ত শিশুদের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যেখানে দ্বিপদী হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় পেলভিসের গঠন বজায় থাকে। এই দুটি অভিযোজন মানুষকে শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের থেকে আলাদা করেছে। এটি কেবল কার্যকর দ্বিপদী চলনই নিশ্চিত করেনি, বরং সরঞ্জাম ব্যবহার এবং অন্যান্য কাজের জন্য হাত দুটিকে মুক্ত করেছে।
গবেষকরা এই পরিবর্তনগুলির সাথে জড়িত ৩০০ টিরও বেশি জিন, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রক উপাদানগুলি (regulatory elements) সনাক্ত করেছেন। এই বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলি মানব বিবর্তনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা চলন এবং মস্তিষ্কের বিকাশের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই গবেষণাটি দেখায় কিভাবে ভ্রূণীয় বিকাশের সামান্য পরিবর্তনগুলিও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বড় ধরনের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন সোজা হয়ে দাঁড়ানো ও হাঁটার ক্ষমতা অর্জন। এই প্রক্রিয়াগুলি বোঝা পেলভিস এবং মেরুদণ্ড সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিতেও সহায়ক হতে পারে।
এই গবেষণাটি বিজ্ঞান জার্নালের মতো অন্যান্য প্রকাশনা থেকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যারা এই বিবর্তনীয় পরিবর্তনের জিনগত প্রভাবগুলি অন্বেষণ করেছে। এই আবিষ্কারগুলি জিনতত্ত্ব, ভ্রূণীয় বিকাশ এবং জীবাশ্মবিদ্যার সমন্বয়ে আন্তঃবিভাগীয় অধ্যয়নের গুরুত্বকে তুলে ধরে, যা মানব বিবর্তন এবং এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে আরও গভীর করে। মানুষের দ্বিপদী চলনের বিবর্তন প্রায় ৪ থেকে ৭ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়েছিল এবং এই অভিযোজন কেবল চলাচলেই সুবিধা দেয়নি, বরং দৃষ্টিসীমা বৃদ্ধি, শক্তি সংরক্ষণ এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ছিল। মুক্ত হাতগুলি সরঞ্জাম তৈরি, খাদ্য বহন এবং এমনকি অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগের মতো নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল।
মানুষের পেলভিসের এই বিশেষ আকৃতি, যা একটি বাটির মতো, এটি দ্বিপদী চলনের সময় শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ওজন স্থানান্তর করতে সাহায্য করে, যা প্রাইমেটদের আরোহণের জন্য ব্যবহৃত লম্বা ও সরু পেলভিস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। SOX9, PTH1R, এবং RUNX2 এর মতো জিনগুলি এই পেলভিসের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয়। জীবাশ্ম প্রমাণ, যেমন ৪.৪ মিলিয়ন বছর আগের আরডিপিথেকাস এবং ৩.২ মিলিয়ন বছর আগের লুসি-র কঙ্কাল, এই বিবর্তনীয় পরিবর্তনের প্রাথমিক এবং উন্নত পর্যায়গুলি নির্দেশ করে। এই পরিবর্তনগুলি প্রায় ৫ থেকে ৮ মিলিয়ন বছর আগে মানুষের আফ্রিকান বানর থেকে পৃথক হওয়ার পর শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।