সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের (WHOI) বিজ্ঞানীরা একটি যুগান্তকারী পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এই নতুন কৌশলটি জলতাপীয় নির্গমনস্থলগুলির (hydrothermal vents) তাপমাত্রার সূক্ষ্ম ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করে কাজ করে। প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় রিজ (East Pacific Rise)-এ ২০২৫ সালে এই পদ্ধতির সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়, যা পৃথিবীর গতিশীলতা বোঝার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
বহু বছর ধরে গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, সমুদ্রের তলদেশ যখন ম্যাগমার কারণে কেঁপে ওঠার জন্য প্রস্তুত হয়, তার অনেক আগেই তাপমাত্রায় অতি ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তনগুলি মাত্র এক ডিগ্রির ভগ্নাংশ মাত্র। এই অতিক্ষুদ্র উষ্ণতার সংকেতগুলিই আসন্ন অগ্ন্যুৎপাতের প্রথম সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। এই পর্যবেক্ষণগুলি প্রমাণ করে যে, মহাসাগর তার অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের বিষয়ে নীরব থাকে না, বরং আগাম সংকেত প্রদান করে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে, WHOI-এর দলটি টিকা ভেন্ট (Tica Vent) নামক এলাকায় তাপমাত্রার একটি ধারাবাহিক এবং ধীরগতিতে বৃদ্ধি রেকর্ড করে। সেই সময়েই বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিলেন যে, সমুদ্রের নিচে ম্যাগমার সঞ্চয় শুরু হয়েছে এবং একটি অগ্ন্যুৎপাতের প্রস্তুতি চলছে।
এই প্রাথমিক অনুমানটি কয়েক মাস পরে, এপ্রিল মাসে, সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়। এপ্রিল মাসে যখন অ্যালভিন (Alvin) নামের ডুবোযানটি প্রায় ২.৫ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় যে সেখানে সত্যিই অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে। এই ঘটনাটি বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক অনুমানকে নিশ্চিত করে এবং নতুন পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করে।
মেরিন জিওফিজিসিস্ট ড্যান ফরনি (Dan Forni) এই আবিষ্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে মন্তব্য করেন: "আমরা প্রথমবারের মতো কেবল ঘটনাটিই নয়, বরং যে প্রক্রিয়াটি সেই ঘটনার দিকে চালিত করে, সেটিও পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি।" তিনি আরও যোগ করেন, "জলতাপীয় নির্গমনস্থলগুলির তাপমাত্রা যেন এক বিশেষ ভাষা, যার মাধ্যমে মহাসাগর তার ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে।"
এই গবেষণা প্রমাণ করে যে জলতাপীয় ব্যবস্থাগুলি কেবল অনন্য জীবদের জীবনধারণের ক্ষেত্র (biological oases) নয়। বরং এগুলি সংবেদনশীল জানালা হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে গ্রহের অভ্যন্তরীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রথম কম্পন অনুভূত হওয়ার অনেক আগেই মহাসাগর যে টেকটোনিক পরিবর্তনগুলির বিষয়ে আগাম সংকেত দিতে পারে, এই পর্যবেক্ষণগুলি সেই সত্যকেই তুলে ধরে।
এভাবেই জন্ম নিচ্ছে একটি নতুন বিজ্ঞান—'ওশেনিক প্রেডিক্টিভ জিওফিজিক্স' (Oceanic Predictive Geophysics)। এই ক্ষেত্রে জলের তাপমাত্রা পূর্বাভাস দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে এবং সমুদ্রের গভীরতা পৃথিবীর রহস্য উন্মোচনে মানুষের অংশীদার হিসেবে কাজ করে। এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে সমুদ্রের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।