ডুবে থাকা যুদ্ধাস্ত্র এখন প্রবাল প্রাচীর: প্রকৃতি, মানুষ ও সমুদ্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা জানা গেল

সম্পাদনা করেছেন: Inna Horoshkina One

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জংধরা গোলাবারুদ ইউরোপের সমুদ্রগুলিকে দূষিত করছে

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে গবেষকরা লুকবেকার উপসাগরে এমন কিছু আবিষ্কার করলেন, যা বাল্টিক সাগরের তলদেশে কেউ আশা করেনি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল হয়ে যাওয়া যুদ্ধাস্ত্রের ওপর জন্মাচ্ছে ঘন, প্রাণবন্ত সামুদ্রিক জীবগোষ্ঠী, যারা মরিচা ধরা ধাতব কাঠামোকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে।

Морская звезда ( Asterias rubens ) на куске тротила, части неразорвавшейся нацистской крылатой ракеты на дне Любекского залива. Фотография: Андрей Веденин/DeepSea Monitoring Group/AFP/Getty

যে বস্তুগুলো ধ্বংসের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই এখন জীবন ধারণের ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

ঠিক এই বিস্ময়কর ঘটনাটিই ২০২৫ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

১. যেখানে যুদ্ধের আবর্জনা, সেখানেই সামুদ্রিক উদ্যান

সেনকেনবার্গ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা একটি দূর নিয়ন্ত্রিত যান (ROV) নামিয়েছিলেন পুরনো সামরিক সরঞ্জাম ফেলার স্থানটি পরীক্ষা করার জন্য।

তাঁরা আশা করেছিলেন, হয়তো মৃত ধাতু, বিষাক্ত পদার্থের ছোপ বা নিছক শূন্যতা দেখতে পাবেন।

কিন্তু যন্ত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরল:

প্রতি বর্গমিটারে পাওয়া গেল ৪০,০০০-এরও বেশি জীবন্ত প্রাণী।

এই ঘনত্ব প্রবাল প্রাচীরের ঘনত্বের সমান।

এটি আশেপাশের সমুদ্রতল বা বাল্টিকের স্বাভাবিক পলিমাটির চেয়েও বেশি জীবন্ত।

এর কারণ কী?

বাল্টিক সাগর মূলত নরম পলি দ্বারা গঠিত এবং এখানে পাথরের অভাব রয়েছে, কারণ মানুষ বহু আগে নির্মাণকাজের জন্য পাথর তুলে নিয়েছে।

যুদ্ধের এই লোহাগুলোই প্রকৃতির কাছে সহজলভ্য কঠিন কাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।

সমুদ্র এই ধাতুর উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি; সে কেবল জীবনধারণের জন্য এটিকে ব্যবহার করেছে।

২. নতুন আধার হিসেবে যুদ্ধাস্ত্র: বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বাল্টিক সমুদ্রের তলদেশ মূলত নরম কাদা বা পলিমাটি।

এখানে কঠিন ভিত্তি খুব কম, কারণ উনিশ ও বিশ শতকে বাড়িঘর তৈরির জন্য প্রাকৃতিক নুড়ি পাথরগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল।

১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চলা এই ‘পাথর উত্তোলন’ সমুদ্রের তলদেশের স্থাপত্যকে আমূল বদলে দেয়।

ফলে, যখন V-1 ক্ষেপণাস্ত্র, আর্টিলারি শেল বা বিমান বোমাগুলির ধাতব কাঠামো গভীর সমুদ্রে পৌঁছাল, তখন তারা এমন কিছুর জোগান দিল যা দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল:

  • ঝিনুক বা মাসেলের জন্য স্থায়ী আশ্রয়,

  • তারামাছের বসার স্থান,

  • মাছের লুকানোর জায়গা,

  • এবং কড মাছের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র।

  • কাঠামো মানেই জীবন।

    যুদ্ধাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়েছে; কেবল তার আকৃতিটিই টিকে আছে।

    ৩. বিষাক্ততা আছে, কিন্তু প্রকৃতি যতটা ভাবা হয় তার চেয়েও বিচক্ষণ

    গবেষকদের প্রতিবেদনে (কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, সেপ্টেম্বর ২০২৫) উল্লেখ করা হয়েছে:

    • হ্যাঁ, টিএনটি (TNT) এবং আরডিএক্স (RDX) চুইয়ে পড়ছে;

  • হ্যাঁ, এর ঘনত্ব বিপজ্জনক হতে পারে;

  • হ্যাঁ, যুদ্ধের রাসায়নিক চিহ্ন কাছাকাছি শনাক্ত করা গেছে।

  • কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, জীবন্ত প্রাণীরা বিস্ফোরক পদার্থের ওপর নয়, বরং ধাতব অংশগুলোর ওপর ভিড় করছে।

    জলজ জীবেরা দূষিত উপাদানকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলছে।

    এটি কোনো সংগ্রাম নয়; এটি হলো বাস্তুতন্ত্রের স্ব-নিয়ন্ত্রণ

    প্রকৃতি যেভাবে স্থানকে শ্রেণিবদ্ধ করে, এটি তার এক চমৎকার উদাহরণ:

    • ✨ এখানে জীবন ধারণ সম্ভব,

  • ✨ এখানে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ নেই।

  • কোনো নাটকীয়তা নেই, কোনো নৈতিকতা নেই—কেবলমাত্র ব্যবস্থার শক্তির যুক্তি কাজ করছে।

    ৪. সমুদ্রে ১.৬ মিলিয়ন টন অস্ত্র: এমন উত্তরাধিকার যা শ্বাস নিচ্ছে

    জার্মানির জলসীমার নিচে আনুমানিক ১.৬ মিলিয়ন টন পুরনো অস্ত্র মজুত রয়েছে।

    এখন জানা গেল, এই ধাতব অতীতের একটি অংশ জৈবিক ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করেছে।

    গবেষণার এলাকায় নাৎসি আমলের দশটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, V-1 বা Fi 103 পাওয়া গেছে।

    যা একসময় শহর ধ্বংস করতে উড়ত, তা এখন গভীর সমুদ্রে জীবনকে টিকিয়ে রেখেছে।

    এটি কোনো রূপক নয়; এটি বাস্তব সত্য।

    ৫. অপসারণ নাকি রেখে দেওয়া? বাল্টিকের প্রধান পরিবেশগত দ্বন্দ্ব

    সমুদ্রের তলদেশ পরিষ্কার করা নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি কাজ।

    বিস্ফোরণের ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদি দূষণ উপেক্ষা করা যায় না।

    কিন্তু যদি এই যুদ্ধাস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলা হয়, তবে সেগুলোর চারপাশে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রও বিলীন হয়ে যাবে।

    এটি বিজ্ঞানীদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে:

    আমরা কি সমুদ্রকে পরিষ্কার করতে পারি, আমাদের আবর্জনার ওপর প্রকৃতি যে জীবন সৃষ্টি করেছে, তাকে ধ্বংস না করে?

    বিজ্ঞানীরা একটি সমাধান প্রস্তাব করেছেন:

    • ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত যুদ্ধাস্ত্রগুলোর পরিবর্তে

  • বিশেষভাবে নকশা করা কংক্রিটের কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর স্থাপন করা হবে।

  • এর উদ্দেশ্য হলো:

    • পরিবেশের জৈবিক কাঠামো সংরক্ষণ করা,

  • বিস্ফোরণের ঝুঁকি দূর করা,

  • বিষাক্ততা হ্রাস করা,

  • এবং জীবনকে তার নতুন বাসস্থানে থাকতে দেওয়া।

  • জার্মানি ইতোমধ্যে একটি পাইলট প্রকল্পের জন্য ১০০ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে।

    বহু দশক পর এই প্রথম আলোচনা হচ্ছে অস্ত্র অপসারণ নিয়ে নয়, বরং পরিবেশগত প্রজ্ঞার সঙ্গে সেটিকে প্রতিস্থাপন করার বিষয়ে।

    ৬. বাল্টিক আমাদের কী বলছে—শব্দহীন দর্শন

    এটি যুদ্ধ বা ধাতব আবর্জনা নিয়ে গল্প নয়।

    এটি প্রকৃতির বেঁচে থাকার গল্প:

    যেখানে আকার আছে, সেখানেই জীবনের আগমন ঘটবে।

    যেখানে কাঠামো আছে, সেখানেই সম্প্রদায়ের জন্ম হবে।

    যেখানে স্থান আছে, সেখানেই শৃঙ্খলা তৈরি হবে।

    মানুষ যা পারেনি, বাল্টিক সাগর তা করে দেখাচ্ছে:

    • এটি ধ্বংসকে অবলম্বন বা সাপোর্টে পরিণত করে।

  • এটি যুদ্ধের ধাতু গ্রহণ করে, কিন্তু যুদ্ধের উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করে না।

  • এটি প্রমাণ করে যে জীবন নিখুঁত পরিবেশ থেকে নয়, বরং সহজলভ্য সুযোগ থেকে জন্ম নেয়।

  • এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটি মনে করিয়ে দেয়:

    যতক্ষণ বৃদ্ধির সুযোগ থাকে, ততক্ষণ কোনো স্থানই মৃত নয়।

    যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষও ভবিষ্যতের ভিত্তি হতে পারে।

    উৎসসমূহ

    • The Guardian

    • Yahoo News Australia

    • The Guardian

    • Mental Floss

    • SciTechDaily

    আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?

    আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।