এই পানির নিচে স্পিকারটি একটি গান বাজাচ্ছে যা প্রবাল রিফগুলিকে ফিরে জীবিত করছে!
শব্দের শক্তি: প্রবালের দ্বিতীয় জীবন
লেখক: Inna Horoshkina One
যখন কোনো প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসের মুখে পড়ে, তখন রং মুছে যাওয়ার আগেই সেখানে নেমে আসে গভীর নীরবতা। চিংড়ির খটখট শব্দ থেমে যায়, মাছের ক্লিক করার আওয়াজ কমে আসে, এবং জীবনের পটভূমির কম্পন বিলীন হয়ে যায়। আর এই নীরবতার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যায় সেই দিকনির্দেশক, যা বহু সামুদ্রিক প্রাণী তাদের গন্তব্যের জন্য ব্যবহার করে—একটি সুস্থ প্রাচীরের প্রাণবন্ত শব্দ।
সমুদ্রের কণ্ঠ: রিফ পুনরুদ্ধারের জন্য শব্দ একটি সরঞ্জাম হিসেবে
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরে সন্দেহ করে আসছিলেন যে প্রবাল প্রাচীরগুলি কেবল জলের নিচের সুন্দর বাগান নয়, বরং জটিল অ্যাকোস্টিক সিস্টেম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতেই এই ধারণাটি সুনির্দিষ্ট এবং জোরালো প্রমাণ পেয়েছে।
ডব্লিউএইচওআই (WHOI) পরীক্ষা: কীভাবে প্রাচীরের শব্দ ফিরিয়ে আনা হলো
অ্যাকোস্টিক উপায়ে প্রবাল প্রাচীর পুনরুদ্ধারের প্রথম গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন (Woods Hole Oceanographic Institution - WHOI)-এর বিজ্ঞানীদের দ্বারা তৈরি রিফ সলিউশনস (Reef Solutions) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের অংশ।
২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা সেন্ট-জন দ্বীপের (ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, ইউএসএ) উপকূলের প্রাচীরগুলিতে প্রকৃত মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু করেন।
গবেষকরা জলের নিচে বিশেষ স্পিকার স্থাপন করেন এবং একটি সুস্থ প্রাচীরের রেকর্ড করা শব্দ বাজাতে শুরু করেন। এই শব্দগুলি ছিল একটি জীবন্ত ইকোসিস্টেমের স্বাভাবিক শব্দ পটভূমি:
চিংড়ির খটখট শব্দ,
মাছের ক্লিক,
মাইক্রোভাইব্রেশনের মৃদু গুঞ্জন,
এবং সেই জৈবিক 'শহরের কোলাহল' যা প্রাচীরের অবনতির সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছিল।
২০২৪–২০২৫ সালের ফলাফল ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য:
মাছের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল;
বহু বছর আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া প্রজাতিগুলি ফিরে এসেছিল;
প্রবালের লার্ভার বসতি স্থাপন সাত গুণ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল;
এবং প্রাচীরের কাঠামো বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্ব-পুনরুদ্ধার শুরু করেছিল।
১২ মার্চ ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এবিসি নিউজ (ABC News) উল্লেখ করে, গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে “প্রাচীরটি ঠিক সেভাবেই জীবনকে আকর্ষণ করছে, যেমন বাতিঘর জাহাজকে আকর্ষণ করে।”
২০২৪ সালের ডব্লিউএইচওআই (WHOI)-এর সরকারি প্রতিবেদনে এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে বলা হয়েছে:
“শব্দ হলো সেই বাতিঘর, যা সামুদ্রিক জীবনকে বাড়ির দিকে পথ দেখায়।”
শব্দ কেন প্রাচীরকে সজীব করে তোলে: কম্পনের বিজ্ঞান
১. অ্যাকোস্টিক ল্যান্ডস্কেপ ধরে প্রবালরা বাড়ি খুঁজে নেয়
অক্টোবর ২০২১-এ নেচার কমিউনিকেশনস (Nature Communications)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা দেখায়: প্রবালের লার্ভা কেবল আলো, রাসায়নিক সংকেত বা স্রোতের উপর নির্ভর করে না, তারা শব্দের উপর ভিত্তি করে দিক নির্ণয় করে। যেখানে ‘মাছের শহর’ বেশি জোরে বাজে, তারা সেই দিকেই সাঁতার কাটে। একটি সুস্থ প্রাচীর কোলাহলপূর্ণ হয়; একটি মৃত প্রাচীর নীরব থাকে। শব্দ ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা প্রাচীরকে দৃশ্যমান হওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন।
২. মাইক্রোভাইব্রেশন প্রবালের পুনর্জন্মকে ত্বরান্বিত করে
২০২৩ সালে ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেরিন সায়েন্স (Frontiers in Marine Science)-এ প্রকাশিত সামুদ্রিক বায়োঅ্যাকোস্টিকসের উপর একটি কাজ প্রমাণ করে যে দুর্বল কিন্তু স্থিতিশীল কম্পনগুলি প্রবালের জন্য অত্যন্ত উপকারী:
এগুলি প্রবালের বিপাক প্রক্রিয়া দ্রুত করে;
সহজীবী শৈবাল পুনরুদ্ধার করে;
তাপমাত্রার চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়;
এবং ক্ষতির পরে টিস্যু পুনরুদ্ধারকে উদ্দীপিত করে।
প্রবালগুলি কেবল নিষ্ক্রিয় কাঠামো নয়। এগুলি হলো জীবন্ত কম্পনশীল ব্যবস্থা, যা চারপাশের বিশ্বের ফ্রিকোয়েন্সিতে সাড়া দেয়।
৩. পরমাণু থেকে কোষ পর্যন্ত বস্তুর নিজস্ব কম্পন রয়েছে
আধুনিক বায়োফিজিক্স জীবনকে অনুরণনের মিথস্ক্রিয়া হিসাবে দেখে। ২০২২ সালে জার্নাল অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি (Journal of Physical Chemistry)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা জোর দিয়ে বলে: পরমাণু, অণু এবং কোষগুলির নিজস্ব কোয়ান্টাম কম্পন স্বাক্ষর (quantum vibrational signatures) রয়েছে। এটি নিছক কল্পনা নয়—এটি পদার্থবিজ্ঞান:
পরমাণু একটি দোলকের (oscillator) মতো আচরণ করে,
অণু একটি ক্ষুদ্র অনুরণক (resonator) হিসাবে কাজ করে,
এবং কোষ হলো একটি অ্যাকোস্টিক সিস্টেম, যা বাহ্যিক ফ্রিকোয়েন্সিতে সাড়া দেয়।
সুতরাং, শব্দ কেবল প্রাণীদের যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটি শক্তি এবং তথ্য বিনিময়ের একটি সার্বজনীন উপায়।
শব্দ—স্মৃতি ফিরিয়ে আনে
যখন বিজ্ঞানীরা সুস্থ প্রাচীরের শব্দগুলি বাজালেন, তখন কেবল মাছের আগমন ঘটেনি, তার চেয়েও বড় কিছু ঘটেছিল। প্রাচীরটি যেন স্মরণ করেছিল যে এটি কেমন ছিল। এটি সজীব হয়ে উঠেছিল—ঠিক সেই জীবের মতো, যাকে তার ভুলে যাওয়া স্পন্দন ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রিফ সলিউশনস (Reef Solutions) প্রকল্পের অনেক অংশগ্রহণকারী এই অনুভূতিটি লক্ষ্য করেছিলেন: যদি ইকোসিস্টেমকে তার হারানো ছন্দ ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তবে এটি নিজেই পুনরুদ্ধার শুরু করে।
এই অভিজ্ঞতা বিশ্ব এবং মানুষ সম্পর্কে আমাদের কী বলে
যদি একটি মৃত প্রাচীর তার নিজস্ব শব্দ শুনে সজীব হতে পারে, তবে প্রশ্ন জাগে: শব্দ কেবল প্রকৃতিকেই নয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলিকেও কতটা গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে?
পরীক্ষা এবং গবেষণা থেকে তিনটি সার্বজনীন সিদ্ধান্ত টানা যায়:
✨ প্রাকৃতিক কম্পন ফিরিয়ে এনে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
✨ মানুষ তার অভ্যন্তরীণ শব্দ—চাপ দ্বারা বিকৃত না হওয়া স্বাভাবিক ছন্দ—শুনতে পেলে স্থিতিশীলতা অর্জন করে।
✨ সভ্যতা তখনই নবায়ন হয়, যখন এটি বিশৃঙ্খলার সাথে নয়, বরং ঐকতানের (harmony) সাথে অনুরণিত হয়।
আমরা শব্দকে জীবনের অলঙ্কার—সংগীত, সমুদ্রের কোলাহল, কণ্ঠস্বর—হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু সম্ভবত এটি আরও গভীর:
শব্দ হলো বিশ্বের উৎস কোড (source code)।
যখন মানুষ তার নিজস্ব বিশুদ্ধ ধ্বনিতে ফিরে আসে—মনোযোগ, স্বচ্ছতা, প্রেম, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার দিকে—তখন সে ঐকতানের কেন্দ্রে পরিণত হয়, যার চারপাশে “স্থান কাঠামোগত হয়”, ঠিক যেমন প্রবাল প্রাচীরগুলি তাদের প্রাকৃতিক ছন্দের প্রতিক্রিয়ায় কাঠামোগত হয়।
এবং মূল কথা: জীবন যতটা মনে হয় তার চেয়েও জ্ঞানী
জীবন সবসময় মনে রাখে কীভাবে শব্দ করতে হয়—কেবল এমন একটি স্থান তৈরি করতে হবে যেখানে তার সংগীত আবার শোনা যায়।
এই বিষয়ে আরও খবর পড়ুন:
আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?
আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।
