পূর্ব আফ্রিকার মহাফাটল: নতুন মহাসাগর সৃষ্টির ইঙ্গিত

সম্পাদনা করেছেন: Tetiana Martynovska 17

পূর্ব আফ্রিকান মহাফাটল ব্যবস্থা (East African Rift System - EARS) পৃথিবীর বুকে এক বিশাল ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো, যা মোজাম্বিক থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত প্রায় ৬,৪০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই ফাটলটি আফ্রিকান মহাদেশের সক্রিয় বিভাজনের সীমানা নির্দেশ করে, যেখানে নুবিয়ান প্লেট এবং সোমালি প্লেট একে অপরের থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চললেও, সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে একটি নতুন মহাসাগর সৃষ্টির সম্ভাবনা পূর্বের ধারণার চেয়ে অনেক আগেই বাস্তবে রূপ নিতে পারে, যা আগামী ১০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ বছরের মধ্যে ঘটতে পারে।

মহাদেশীয় বিভাজনের এই প্রক্রিয়া বর্তমানে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে। ভূ-পৃষ্ঠের টান অনুভূত হওয়ায় রাস্তাঘাট বেঁকে যাচ্ছে এবং নতুন উষ্ণ প্রস্রবণ দেখা দিচ্ছে। জিপিএস তথ্যও ভূমি প্রসারিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছে। ফাটল অঞ্চলে প্রায়শই ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ এবং ভূ-ত্বকে নতুন ফাটল উন্মোচিত হচ্ছে। এই চলমান রূপান্তর বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর গতিশীল ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলি বোঝার এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে মহাদেশীয় ভাঙন বাস্তব সময়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে।

সোমালি, নুবিয়ান এবং আরব প্লেটের সংযোগস্থল আফার অঞ্চলটি বিশেষভাবে সক্রিয়। এই অঞ্চলে ২০০৫ সালে এক ধারাবাহিক ভূমিকম্পের ফলে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ফল্ট লাইন তৈরি হয়েছিল, যা ক্রমাগত চওড়া ও গভীর হচ্ছে। এই ধরনের ভূ-তাত্ত্বিক নাটকীয়তা মানব অভিজ্ঞতার সময়সীমার বাইরে হলেও, এটি প্রকৃতির এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়—যা কেবল একটি ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, বরং পৃথিবীর অভ্যন্তরের শক্তির এক বিশাল বহিঃপ্রকাশ। এই বিভাজন পৃথিবীর অভ্যন্তরের গভীর চাপ ও উত্তাপের ফল। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে এই ফাটলটি লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি বৃহত্তর ব্যবস্থার অংশ, যা একসময় আটলান্টিক মহাসাগর সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ের অনুরূপ ছিল।

এই প্রক্রিয়াটি এতটাই ধীর যে মানুষের জীবনে এর প্রভাব সরাসরি বোঝা কঠিন, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি সুদূরপ্রসারী। গবেষণায় দেখা গেছে যে ফাটলের উত্তর অংশে সম্প্রসারণের হার দক্ষিণের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত, কিছু অংশ প্রতি বছর ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চওড়া হচ্ছে—যা নখের বৃদ্ধির হারের সাথে তুলনীয়, তবুও সহস্রাব্দ ধরে মহাদেশগুলিকে নতুন আকার দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। এই ত্বরান্বিত বিভাজন ভূত্বকের নিচে থেকে ম্যান্টল প্লুমের উত্থানের কারণে ঘটে, যা কার্যকরভাবে টেকটোনিক প্লেটগুলিকে নিচ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। আফার অঞ্চলের মতো কিছু স্থানে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়, যা এই অঞ্চলের চরম ভূ-তাত্ত্বিক অস্থিরতার সাক্ষ্য বহন করে। এই মহাফাটলটি শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের জলে প্লাবিত হলে, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার অংশবিশেষ একটি পৃথক দ্বীপ বা মহাদেশে পরিণত হতে পারে, যা বৈশ্বিক মানচিত্রকে চিরতরে বদলে দেবে। এই পরিবর্তন স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্থিতিশীল বলে যা মনে হয়, তা আসলে এক নিরন্তর প্রবাহের অংশ, যেখানে প্রতিটি পরিবর্তনই এক নতুন বিন্যাসের প্রস্তুতি।

উৎসসমূহ

  • WION

  • The Daily Galaxy

  • Stewartville Star

  • Newsweek

আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?

আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।