২০২৫ সালের ১৮ই অক্টোবর, বিশ্বজুড়ে একশোরও বেশি বিজ্ঞানী এক অভূতপূর্ব ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, পৃথিবীর প্রথম জলবায়ু সংকট-উত্তরণ বিন্দু বা 'টিপিং পয়েন্ট' পার হয়ে গেছে, যার প্রধান সূচক হলো প্রবাল প্রাচীরের ভয়াবহ অবক্ষয়। এই ঘোষণা মানবজাতির সম্মিলিত যাত্রাপথের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করে, যেখানে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতা এক নতুন সীমানায় পৌঁছেছে। মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি দহন এবং এর ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা ইতোমধ্যে তীব্র তাপপ্রবাহ, বিধ্বংসী বন্যা, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও লাগামছাড়া দাবানলের জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন যে, নিকট ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর রূপান্তরের আশঙ্কা রয়েছে, যা গ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রগুলিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এই পরিবর্তনের ঢেউ আমাজন রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত, যার প্রতিক্রিয়া সমগ্র গ্রহের উপর অনুভূত হবে। উষ্ণ জলের প্রবালগুলি এই পরিবর্তনের প্রথম শিকার। সমুদ্রের তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর কারণে, ২০২৩ সালের পর থেকে সবচেয়ে বড় প্রবাল বিবর্ণতা (bleaching) দেখা গেছে, যা প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর এলাকাকে প্রভাবিত করেছে। একসময়কার বর্ণিল সমুদ্রতল এখন শৈবাল-প্রধান এক বিবর্ণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল সিস্টেমস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক টিম লেন্টন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, “আমরা দ্রুত অনেকগুলো পৃথিবীর সিস্টেম টিপিং পয়েন্টের কাছাকাছি চলে আসছি, যা আমাদের বিশ্বকে বদলে দিতে পারে এবং মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।”
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের সিনিয়র সায়েন্স অ্যাডভাইজার এবং প্রতিবেদনের সহ-লেখক মাইক ব্যারেট মন্তব্য করেছেন, “আমরা এখন প্রবাল প্রাচীরগুলোকে তাদের টিকে থাকার সীমা অতিক্রম করিয়ে দিচ্ছি।” লেখকরা দৃঢ়ভাবে বলছেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন না থামালে রঙিন প্রবাল প্রাচীরগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই প্রাচীরগুলি সামুদ্রিক জীবনের জন্য অপরিহার্য আশ্রয়স্থল, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং উপকূলীয় অঞ্চলকে ঝড় থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে, কারণ পৃথিবী এখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তসীমার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত যে, বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সর্বজনীনভাবে সম্মত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করা হবে। উষ্ণ জলের প্রবালের জন্য ১.২° সেলসিয়াস বৈশ্বিক গড় পৃষ্ঠ তাপমাত্রাকে একটি টিপিং পয়েন্ট থ্রেশহোল্ড হিসেবে সমর্থন করা হয়েছে। সম্ভাব্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি হলো আটলান্টিক মেরিডিওনাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন (AMOC)-এর পতন। ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা ও মানব ভূগোল বিভাগের গবেষক মানজানা মিলচিনস্কি বলেছেন, “বিশ্ব এর জন্য প্রস্তুত নয়।” তিনি যোগ করেন যে, বর্তমান নীতি ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো আকস্মিক, অপরিবর্তনীয় এবং আন্তঃসংযুক্ত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয়, বরং ধীরে ধীরে পরিবর্তনের জন্য তৈরি।
এই পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সম্মিলিত মনোযোগের ক্ষেত্র পরিবর্তন করা প্রয়োজন। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌর ও বায়ুশক্তির মতো পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎসগুলিতে দ্রুত স্থানান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে নির্গমন হ্রাস করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারণ এবং দ্রুত গ্রহ-উষ্ণতা সৃষ্টিকারী নির্গমন হ্রাস করার জন্য জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। এই প্রতিবেদনটি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য COP30, অর্থাৎ বার্ষিক জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের মাত্র এক মাস আগে প্রকাশিত হয়েছে, যা আগামী দশকে নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নতুন পথে চলার শক্তি খুঁজে নেওয়ার প্রত্যাশা রাখা যায়।