বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ইকুয়েডরের অ্যামাজন অববাহিকার প্রান্তে অবস্থিত নাপো প্রদেশের জেনোভেভা খনি থেকে প্রায় ১১ কোটি ২০ লক্ষ বছর পুরানো ক্রিটেসিয়াস যুগের অ্যাম্বারে সংরক্ষিত প্রাগৈতিহাসিক পোকামাকড়ের এক অভূতপূর্ব আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। এই অমূল্য নমুনাগুলি পৃথিবীর জীবনে এক বিরল অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যখন প্রায় ১১ কোটি ২০ লক্ষ বছর আগে, নিম্ন ক্রিটেসিয়াস যুগের আলবিয়ান পর্যায়ে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য এক নতুন রূপ নিচ্ছিল। এই আবিষ্কারটি দক্ষিণ আমেরিকায় জীবাশ্মীভূত গাছের রজন বা অ্যাম্বারে প্রাচীন পোকামাকড়, যেমন - গুবরে পোকা, মাছি, পিঁপড়া এবং বোলতা সংরক্ষণের প্রথম ঘটনা।
বিগত ১৩ কোটি বছরের প্রায় সমস্ত পরিচিত অ্যাম্বার সঞ্চয় উত্তর গোলার্ধে পাওয়া গেছে, তাই দক্ষিণ গোলার্ধে, বিশেষ করে পূর্বে গন্ডোয়ানা মহাদেশের অংশ থাকা অঞ্চলে এমন নিদর্শনের অভাব বিজ্ঞানীদের কাছে দীর্ঘকাল ধরে একটি "রহস্য" ছিল। অ্যাম্বারকে প্রায়শই "অতীতের ক্ষুদ্র জানালা" হিসাবে বর্ণনা করা হয়, কারণ এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম জীব এবং পরিবেশগত বিবরণ সংরক্ষণ করতে পারে যা অন্যথায় হারিয়ে যেত। এই অ্যাম্বারের মধ্যে কেবল পোকামাকড়ই নয়, মাকড়সার জালের অংশ এবং পরাগ ও পাতার মতো উদ্ভিদ জীবাশ্মও পাওয়া গেছে।
এটি ইঙ্গিত দেয় যে সেই সময়ে এই অঞ্চলে একটি আর্দ্র, রজন-উৎপাদনকারী বনভূমি বিদ্যমান ছিল, যা আজকের আমাজন থেকে ভিন্ন ছিল। গবেষকরা দুটি ভিন্ন ধরণের অ্যাম্বার সনাক্ত করেছেন: একটি গাছের শিকড়ের চারপাশে ভূগর্ভে গঠিত হয়েছিল এবং অন্যটি বায়ুর সংস্পর্শে এসে তৈরি হয়েছিল, যা পোকামাকড়কে আটকে রেখেছিল। এই প্রাচীন বনভূমিতে ফার্ন, সাইকাড এবং প্রাথমিক অ্যাঞ্জিওস্পার্মের মতো গাছপালা ছিল, যার মধ্যে কিছু প্রজাতি, যেমন "মাংকি পাজল ট্রি", বর্তমানে আমাজনিয়ায় আর পাওয়া যায় না। এই অ্যাম্বারগুলি মূলত কোনফার গাছের রজন থেকে তৈরি হয়েছিল, যা সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ছিল।
এই আবিষ্কারটি কেবল ক্রিটেসিয়াস যুগে দক্ষিণ গোলার্ধের নিরক্ষীয় অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে না, বরং এটি গন্ডোয়ানা মহাদেশ ভেঙে যাওয়ার সময়কার জৈব-ভৌগোলিক সম্পর্কগুলিকেও আলোকিত করে। অ্যাম্বারে সংরক্ষিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবগুলি, যা অন্যথায় সহজে জীবাশ্মে পরিণত হয় না, সেগুলি সেই সময়ের উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের মধ্যেকার জটিল মিথস্ক্রিয়া বোঝার জন্য মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। এখানে পাওয়া পোকাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের মাছি (যেমন বাইটিং মিডজ যা ডাইনোসরের রক্ত খেত বলে মনে করা হয়), গুবরে পোকা, বোলতা, ফড়িং এবং মাকড়সার জাল।
এই ধরণের আবিষ্কারগুলি, যা উত্তর গোলার্ধের তুলনায় বিরল, তা পৃথিবীর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে জীবনের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই গবেষণাটি প্রায় ২১টি জৈব-অন্তর্ভুক্তি (bio-inclusions) সনাক্ত করেছে, যা পাঁচটি ভিন্ন পোকা গোষ্ঠীর সদস্য। ইউনিভার্সিটি অফ বার্সেলোনা, স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সহযোগিতায় পরিচালিত এই গবেষণাটি 'কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই নমুনাগুলি বর্তমানে ক্রিটেসিয়াস যুগের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও জানতে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এই আবিষ্কারটি কেবল অতীতের এক ঝলকই দেখায় না, বরং এটি আমাদের গ্রহের বিবর্তনের দীর্ঘ যাত্রায় জীবনের ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তনের এক গভীর উপলব্ধির সুযোগও করে দেয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। এই ধরণের গবেষণাগুলি ভবিষ্যতের আরও অনেক আবিষ্কারের পথ খুলে দিতে পারে, যা আমাদের গ্রহের প্রাচীন জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও প্রসারিত করবে।