গবেষকরা পূর্ব অ্যান্টার্কটিকায় একটি প্রাগৈতিহাসিক ভূখণ্ড আবিষ্কার করে ভূতত্ত্বের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এই ভূখণ্ডটি আনুমানিক ৩ কোটি ৪০ লক্ষ বছর ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু বরফের নিচে নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত ছিল। নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি মহাদেশটির বর্তমান বিশাল হিমবাহ শুরু হওয়ার ঠিক আগের একটি অভূতপূর্ব চিত্র তুলে ধরে। এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানীদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি সেই সময়ের অ্যান্টার্কটিকার জগৎকে আলোকিত করেছে, যখন মহাদেশটি আজকের মতো বরফের চাদরে ঢাকা ছিল না, বরং একটি বিশাল জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
এই জটিল ভূ-প্রকৃতি উন্মোচনের জন্য বিজ্ঞানীরা কানাডিয়ান স্যাটেলাইট RADARSAT থেকে প্রাপ্ত অত্যাধুনিক ডেটা ব্যবহার করেছেন। এই ডেটার সাহায্যে ৩২,০০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি পৃষ্ঠের ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা আয়তনে ওয়েলসের মতো একটি দেশের সাথে তুলনীয়। এই বিস্তারিত কার্টোগ্রাফি (মানচিত্রাঙ্কন) একটি জটিল, প্রাক-হিমবাহ ভূ-প্রকৃতি প্রকাশ করেছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে পাখা-আকৃতির সুবিন্যস্ত উপত্যকা, জলের নিচে ডুবে যাওয়া পর্বতশ্রেণী এবং প্রায় ১,৫০০ মিটার গভীর ফিয়র্ড। এই ধরনের গভীর খাঁজ এবং উপত্যকার উপস্থিতি জোরালোভাবে ইঙ্গিত করে যে লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই অঞ্চলে শক্তিশালী, প্রাচীন নদী ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল, যা এই বিশাল ভূদৃশ্যটিকে ভাস্কর্য করেছিল।
এই আবিষ্কৃত 'হারিয়ে যাওয়া জগৎ'কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জলবায়ু, উদ্ভিদ এবং জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত স্বাক্ষর ধরে রাখা এক গুরুত্বপূর্ণ টাইম ক্যাপসুল হিসেবে দেখছেন। এই ভূদৃশ্যটি ঠিক তখনই বরফের নিচে সিল হয়ে যায় যখন গ্রহটি একটি উল্লেখযোগ্য শীতলতার দিকে ঝুঁকছিল। এই শীতলতার প্রবণতাটি প্রায় ৩ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে ইওসিন (Eocene) এবং অলিগোসিন (Oligocene) যুগের মধ্যেকার রূপান্তর দ্বারা চিহ্নিত। এই সময়টি পৃথিবীর জলবায়ু ইতিহাসে একটি মোড় হিসেবে পরিচিত।
ঐতিহাসিক এই রূপান্তরের সময় বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্বে একটি নাটকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হ্রাস ঘটেছিল। কার্বন ডাই অক্সাইডের এই পতনই অ্যান্টার্কটিকায় বিশাল হিমবাহের ঘটনাটিকে ট্রিগার করেছিল। ম্যাপিং প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনটি প্রধান উঁচু ভূমিভাগ চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে 'হাইল্যান্ড এ' (Highland A)। এই স্থানটিতেই নদী দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়কার্য জটিল, শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট উপত্যকা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। বরফের নিচে চাপা পড়ার কারণে ভূখণ্ডটি সেই সময়ে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই রয়ে গেছে, যা বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার এক অমূল্য ভান্ডার।
কীভাবে এই প্রাচীন ভূ-প্রকৃতি যুগ যুগ ধরে এমন চরম পরিস্থিতিতে টিকে রইল, তা বোঝা আজকের বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে অ্যান্টার্কটিক বরফের চাদরের ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। যদি এই বরফের চাদর গলে যায়, তবে এর নিচে লুকিয়ে থাকা এই প্রাচীন ভূখণ্ডটি উন্মোচিত হবে। উপরন্তু, বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন যে প্রাচীন শিলাস্তরের এই ভূ-প্রকৃতি আধুনিক বরফের প্রবাহের গতিশীলতাকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর অর্থ হলো, লক্ষ লক্ষ বছর আগের এই ভূদৃশ্যটি পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে যে বর্তমান সময়ে অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাদরটি কীভাবে আচরণ করছে এবং প্রবাহিত হচ্ছে।