ডঃ জেন গুডঅল পেলেন প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম, জীবনব্যাপী অবদানের স্বীকৃতি

সম্পাদনা করেছেন: Olga Samsonova

প্রখ্যাত প্রাইমাটোলজিস্ট এবং পরিবেশবিদ ডঃ জেন গুডঅল ২০২৫ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম লাভ করেন। এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, যা কেবল সেইসব ব্যক্তিদের প্রদান করা হয় যারা দেশের সমৃদ্ধি, মূল্যবোধ, নিরাপত্তা, বিশ্ব শান্তি অথবা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জনহিতকর কাজে অসাধারণ অবদান রেখেছেন।

ডঃ গুডঅলের বিজ্ঞান ও পরিবেশ সুরক্ষায় তাঁর আজীবন নিবেদিতপ্রাণ কাজ এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা তাঁকে প্রদান করা হয়। ১৯৬০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঞ্জানিয়ার গম্বেতে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনাকে নতুন পথে চালিত করে। তিনি কেবল প্রাণীদের আচরণই নয়, বরং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেকার সীমারেখাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে শিম্পাঞ্জিদেরও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, জটিল সামাজিক বন্ধন, আবেগ এবং এমনকি হাতিয়ার ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে, যা এতদিন কেবল মানুষের একচেটিয়া বলে মনে করা হতো। এই আবিষ্কারগুলি প্রাইমাটোলজি (primatology) ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিল এবং মানবজাতির সঙ্গে প্রকৃতির গভীর, অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিল।

ডঃ গুডঅল তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯৭৭ সালে জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট (JGI) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বজুড়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, আবাসস্থল পুনরুদ্ধার এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক উন্নয়নমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে তিনি লক্ষ লক্ষ একর বনভূমি সংরক্ষণে সহায়তা করেছেন এবং শত শত শিম্পাঞ্জিকে আশ্রয় দিয়েছেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে তিনি 'রুটস অ্যান্ড শুটস' (Roots & Shoots) কর্মসূচি চালু করেন, যার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ তরুণকে পরিবেশগত ও মানবিক কাজে উৎসাহিত করা হয় এবং তাদের মধ্যে পরিবর্তনের দূত হওয়ার প্রেরণা জাগানো হয়। এই উদ্যোগগুলি বিশ্বজুড়ে মানুষকে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনুপ্রাণিত করেছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সম্মাননা প্রদানের সময় ডঃ গুডঅলের সক্রিয়তা, দূরদৃষ্টি এবং আশার বার্তার প্রশংসা করেন, যা বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, "জেন তাঁর সক্রিয়তা, দূরদৃষ্টি এবং আশার বার্তার মাধ্যমে গ্রহকে রক্ষা করার জন্য একটি বৈশ্বিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সর্বোপরি, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে যখন আমরা আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে মানবতা খুঁজি, তখন আমরা নিজেদের মধ্যেই তা আবিষ্কার করি।" তাঁর ২০২১ সালে প্রকাশিত "দ্য বুক অফ হোপ" (The Book of Hope) বইটি মানুষের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, প্রকৃতির অদম্য সহনশীলতা, তরুণ প্রজন্মের শক্তি এবং হার না মানা মানব চেতনার মতো আশার চারটি মূল কারণকে তুলে ধরেছে। এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে কঠিনতম পরিস্থিতিতেও কীভাবে আশা বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং কীভাবে সেই আশাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তোলা যায়।

ডঃ গুডঅল জাতিসংঘের শান্তির দূত (UN Messenger of Peace) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন্যপ্রাণী সুরক্ষার মতো বিষয়গুলিতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি প্রায়শই বলতেন, "সবকিছুই সংযুক্ত - প্রত্যেকেই পার্থক্য তৈরি করতে পারে।" তাঁর এই দর্শন তাঁর সমস্ত কাজের মূল ভিত্তি ছিল। এই মহান বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদ ২০২৫ সালের ১লা অক্টোবর ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তাঁর কাজ এবং তাঁর আশার বার্তা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তাঁর জীবনব্যাপী কাজ বিজ্ঞান, পরিবেশবাদ এবং মানবতাকে সংযুক্ত করেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য উত্তরাধিকার রেখে গেছে। তিনি কেবল একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন না, বরং ছিলেন আশা, সহানুভূতি এবং পরিবর্তনের এক মূর্ত প্রতীক, যিনি শিখিয়েছেন যে প্রতিটি ব্যক্তিই ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম।

উৎসসমূহ

  • Hindustan Times

  • President Biden Announces Recipients of the Presidential Medal of Freedom

  • Dr. Jane Goodall Receives the Presidential Medal of Freedom

  • President Biden Announces Recipients of the Presidential Medal of Freedom

আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?

আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।