মেসোআমেরিকার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা বদলে দিতে পারে এমন একটি যুগান্তকারী গবেষণা উপস্থাপন করেছেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ম্যাগনাস ফারাও হ্যানসেন এবং ক্রিস্টোফ হেলমকে। তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি 'কারেন্ট অ্যানথ্রোপোলজি' নামক বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০২৫ সালের ৬ অক্টোবর। এই গবেষণার মূল দাবি হলো, প্রাচীন টিওটিহুয়াকানের ফ্রেস্কো এবং অন্যান্য শিল্পকর্মে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক ব্যবস্থাটি কোনো সাধারণ প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ লিখন পদ্ধতি। মায়া সভ্যতার লিপিগুলি তুলনামূলকভাবে দ্রুত পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলেও, টিওটিহুয়াকানের এই রহস্যময় ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে ভাষাবিদদের কাছে অমীমাংসিত ছিল। তবে এই বিজ্ঞানীরা এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে এই লিপিটি ইউটো-আজটেক ভাষার একটি প্রাথমিক এবং প্রাচীন রূপকে এনকোড করেছে, যা এই অঞ্চলের ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত টিওটিহুয়াকান ছিল সেই সময়ের অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী নগর কেন্দ্র। এর সমৃদ্ধির শিখরে, এই মহানগরের জনসংখ্যা ১,২৫,০০০-এরও বেশি ছিল। এর স্থাপত্যের বিশালতা অনস্বীকার্য হলেও, এর বাসিন্দাদের জাতিগত পরিচয় এবং তারা কোন ভাষায় কথা বলত, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক ছিল। প্রচলিত মত ছিল যে এটি একটি বহু-জাতিগত শহর হওয়ায় এখানে বহু উপভাষা বা স্থানীয় ভাষার সহাবস্থান ছিল। কিন্তু হেলমকে এবং হ্যানসেন ভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা অনুমান করেন যে, ইউটো-নাহুয়া ভাষায় কথা বলা একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই শহরে বিদ্যমান ছিল, এবং তারাই তাদের প্রধান লিখিত ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন রেখে গেছে।
এই ঐতিহাসিক পাঠোদ্ধারের সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগ। বিশেষজ্ঞরা হায়ারোগ্লিফগুলির সাথে ইউটো-আজটেক ভাষার আরও প্রাচীন স্তরের গভীর তুলনা করেছেন। তারা আধুনিক ইউটো-আজটেক বংশধর, যেমন নাহুয়াটল, সেইসাথে কোরা এবং হুইচোল ভাষার সাথে এই প্রাচীন লিপিগুলির সাদৃশ্য খুঁজে বের করেন। গবেষকরা বিশেষ করে 'রেবাস পদ্ধতি' (rebus method) ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতি প্রয়োগের সময় তারা এমন একটি ভাষা ব্যবহার করেছেন যা টিওটিহুয়াকানের ঐতিহাসিক সময়ের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। হ্যানসেন জোর দিয়ে বলেছেন যে, শুধুমাত্র আধুনিক নাহুয়াটল ব্যবহার করে যদি কেউ এই প্রাচীন পাঠ্যগুলি পড়ার চেষ্টা করত, তবে তা একটি মারাত্মক কালানুক্রমিক ভ্রান্তি (অ্যানাক্রোনিজম) হতো। সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করার ফলেই এই গবেষণায় আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া গেছে।
এই আবিষ্কার অভিবাসনের ইতিহাস এবং মধ্য মেক্সিকোর জনবসতি সংক্রান্ত ধারণার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। যদি এই লিখন পদ্ধতিটি সত্যিই ইউটো-নাহুয়া ভাষার মূল পূর্বপুরুষকে নির্দেশ করে, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। এর অর্থ হতে পারে যে আজটেকদের ভাষা নাহুয়াটলের বক্তারা টিওটিহুয়াকানের পতনের (যা প্রায় ৬০০ খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল) পরে এই অঞ্চলে আসেননি, বরং তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত শিকড় সরাসরি এই প্রাচীন নগরীর গভীরে প্রোথিত ছিল। সুতরাং, ইউটো-নাহুয়া সম্প্রদায়গুলি হয়তো পূর্বে যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক আগেই টিওটিহুয়াকানের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মূল স্থপতি হিসেবে কাজ করেছিল। যদিও এটি একটি বিশাল অগ্রগতি, লেখকরা বিনয়ের সাথে স্বীকার করেছেন যে এটি কেবল একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই তত্ত্বের চূড়ান্ত যাচাই এবং নিশ্চিতকরণের জন্য আরও বেশি সংখ্যক লিখিত পাঠ্য বা প্রত্নতাত্ত্বিক লিপির সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ সম্প্রসারণ করা অত্যন্ত জরুরি।