খাওয়ার সময় স্মার্টফোনের উপস্থিতি মনোযোগকে সরিয়ে দেয়: ল্যুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ

সম্পাদনা করেছেন: Elena HealthEnergy

গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে খাবারের সময় স্মার্টফোন হাতের কাছে থাকলে মানুষের দৃষ্টি মূলত ডিভাইসের দিকেই চলে যায়, যদিও মূল মনোযোগ খাদ্যের ওপর থাকার কথা। বেলজিয়ামের ল্যুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় (KU Leuven)-এর বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাটি দেখায় যে কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ কাজগুলোর মধ্যেও এই বহুল ব্যবহৃত ডিজিটাল গ্যাজেটগুলো অজান্তেই আমাদের মানসিক শক্তি শুষে নিচ্ছে। মনোবিজ্ঞান, যা মানুষের মানসিক কার্যকলাপের নিয়মাবলী নিয়ে অধ্যয়ন করে, এই ধরনের ঘরোয়া পরিস্থিতিতে মনোযোগ বণ্টনের মৌলিক নীতিগুলোর প্রমাণ খুঁজে পায়।

এই গবেষণার পরীক্ষামূলক অংশে মোট ২৪ জন ডানহাতি প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণকারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের খাবার খাওয়ার সময় মোবাইল ফোনটি হয় ট্রে-এর বাম দিকে, নয়তো ডান দিকে রাখা হয়েছিল, অথবা একেবারেই রাখা হয়নি। বিজ্ঞানীরা আই-ট্র্যাকিং গ্লাস ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টি অনুসরণ করেন এবং একটি সুনির্দিষ্ট প্রবণতা লক্ষ্য করেন: অংশগ্রহণকারীরা ধারাবাহিকভাবে যেদিকে স্মার্টফোন ছিল, সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করছিল। এই ঘটনাটিকে গবেষকরা ‘পার্শ্বীয় মনোযোগের স্থানান্তর’ বা ল্যাটারাল শিফট অফ অ্যাটেনশন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা একমুখী আকর্ষণের প্রমাণ দেয়। এই স্থানান্তর বাম বা ডান উভয় দিকেই সমানভাবে পরিলক্ষিত হওয়ায় এটি স্পষ্ট যে, ডিভাইসটির শারীরিক উপস্থিতি আমাদের দৃষ্টির দিক পরিবর্তন করতে যথেষ্ট শক্তিশালী। KU Leuven-এর সামাজিক ও মানবিক বিষয় সংক্রান্ত নৈতিক কমিটি (SMEC) এই ফলাফলগুলোকে অনুমোদন করেছে (অনুমোদন নম্বর G-2024-7628-R2(MIN)), যা বাস্তব পরিস্থিতিতে মানুষের মৌলিক মনোযোগ প্রক্রিয়ার ওপর আধুনিক প্রযুক্তির গভীর প্রভাবকে তুলে ধরে।

মনোযোগের এই স্বয়ংক্রিয় আকর্ষণকে বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এটি আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে এবং অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে যা মন দিয়ে কাজ করা বা সচেতনভাবে খাবার খাওয়ার মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ বাড়াতে সহায়ক হবে। খাদ্য সংক্রান্ত আচরণ নিয়ে হওয়া অন্যান্য গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, খাওয়ার সময় গ্যাজেটে মনোযোগ দিলে ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ বাড়ে, যা স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে ভিডিও দেখা বা ফোন ব্যবহারের সময় খাবার যান্ত্রিকভাবে খাওয়া হয়, ফলে স্বাদগ্রন্থিগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, যা পরিতৃপ্তির অনুভূতিকে বাধা দেয়। যুক্তরাজ্যে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা দুপুরের খাবারের সময় টেলিভিশন দেখছিলেন, তারা একা খাওয়া মানুষের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি বিস্কুট খেয়েছিলেন।

টেবিলের ধারে স্মার্টফোন ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মানুষের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ১১৬৩ জন ৮ থেকে ৮৮ বছর বয়সী মানুষের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিলেন। তারা দেখতে পান যে, দীর্ঘ সময় ধরে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের চেয়ে টেক্সট মেসেজ বা সংক্ষিপ্ত কলের আদান-প্রদানকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, কারণ এগুলো কম সময় নেয়। তবে, যদি কারও কাছে জরুরি কাজের জন্য ফোন ব্যবহার করা অপরিহার্য মনে হয়, তবে আশেপাশের মানুষজনও টেবিলের কাছে ফোন থাকার বিষয়টি মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে। অন্যদিকে, জাপানের ‘তানুকি’ ব্র্যান্ড একটি পরীক্ষায় ১০৭৬ জন অতিথির ওপর জরিপ চালিয়ে আবিষ্কার করে যে, ৮৮.৪ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেছেন যে ফোন তাদের মনোযোগ কেড়ে নেয় এবং ঘনিষ্ঠদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এছাড়াও, অতিথিদের ৬৬.৮ শতাংশ জানিয়েছেন যে, এক থেকে দেড় ঘণ্টার জন্য স্মার্টফোনগুলো একটি সিন্দুকে রাখার পর তাদের খাবার অনেক বেশি সুস্বাদু লেগেছে।

এই ঘটনাটির গভীর তাৎপর্য রয়েছে, যেখানে ডিভাইসটি বন্ধ থাকলেও তার শারীরিক উপস্থিতি আমাদের পার্শ্বীয় দৃষ্টি এবং জ্ঞানীয় চাপকে প্রভাবিত করে। আরও স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল পরিবেশ তৈরির জন্য, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ডিভাইসগুলোতে এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা যেতে পারে যা ব্যবহারকারীকে খাওয়ার সময় ফোন ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করবে। মনোযোগ বিঘ্নিত না করে সচেতনভাবে খাবার গ্রহণ করার প্রচেষ্টা কেবল ওজন নিয়ন্ত্রণে নয়, সামগ্রিক সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

উৎসসমূহ

  • Nature

  • Sciety

আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?

আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।