মোল্দোভার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচন আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই নির্বাচন কেবল দেশের আগামী চার বছরের রাজনৈতিক গতিপথই ঠিক করবে না, বরং এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গভীর প্রভাব ফেলবে। তবে, এই নির্বাচনকে ঘিরে রাশিয়ার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে যে, মস্কো এই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য অনলাইন প্রচারণার জাল বিস্তার এবং রুশ-পন্থী দলগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে।
২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল মোল্দোভার সংসদ নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্ত করে। যদিও আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হওয়ার কথা নির্বাচনের ৬০ দিন আগে, অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুলাই মাসের শেষ নাগাদ, রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যেই তাদের কার্যক্রম জোরদার করেছে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন (সিইসি) আশা করছে যে, প্রায় ২.৮ মিলিয়ন নিবন্ধিত ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, যার মধ্যে বিদেশে বসবাসকারী মোল্দোভান নাগরিকরাও (প্রবাসীরা) অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া তার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই নির্বাচনে লক্ষ লক্ষ ইউরো বিনিয়োগ করছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া প্রচার ও হাইব্রিড অপারেশনের জন্য ২০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি অর্থ ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ইউরো হস্তান্তরের অভিযোগও রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভোট কেনার জন্য একটি রুশ ব্যাংক ব্যবহার করে প্রায় ১৩০,০০০ এর বেশি ব্যক্তিকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩৯ মিলিয়ন ডলার। এই ধরনের কার্যক্রম মোল্দোভার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার একটি সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মোল্দোভার এই নির্বাচনকে কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছেন না, বরং এটিকে রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশলের একটি পরীক্ষাগার হিসেবেও বিবেচনা করছেন। মোল্দোভা এমন একটি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে যেখানে রাশিয়া তার প্রভাব বিস্তারের জন্য নতুন নতুন কৌশল পরীক্ষা করতে পারে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলিতেও প্রয়োগ করা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, মোল্দোভার জনগণ তাদের সার্বভৌমত্ব এবং ইউরোপীয় ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার জন্য এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন।
দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি স্পষ্ট বিভাজন লক্ষ্য করা যায় – একদিকে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একীভূতকরণের পক্ষে থাকা দল, যার মধ্যে ক্ষমতাসীন পার্টি অফ অ্যাকশন অ্যান্ড সলিডারিটি (পিএএস) অন্যতম। অন্যদিকে, রাশিয়া-পন্থী দলগুলো দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক জোরদার করার পক্ষে সওয়াল করছে। যদিও পিএএস বর্তমানে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে বিভিন্ন জনমত জরিপ বলছে যে, কোনো একক দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা কঠিন হতে পারে, যার ফলে একটি জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল।
প্রবাসীদের ভোট এই নির্বাচনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। ২০১৪ সালের গণভোট এবং ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটের ফলেই ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। এই বিশাল সংখ্যক ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য রাশিয়া তাদের প্রচারণার লক্ষ্যবস্তু করেছে, যাতে তারা ভোটদানে বিরত থাকে বা রুশ-পন্থী প্রার্থীদের সমর্থন করে। মোল্দোভার প্রায় ১.২ মিলিয়ন নাগরিক বিদেশে বসবাস করেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই বিশাল ভোটার গোষ্ঠীর সমর্থন জয় করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণার কৌশল নির্ধারণ করছে।
এই নির্বাচন মোল্দোভার জন্য একটি সন্ধিক্ষণ, যেখানে দেশটি তার ভবিষ্যৎ পথ বেছে নেবে। একদিকে যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একীভূতকরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার হাতছানি, তেমনই অন্যদিকে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কাও বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে, মোল্দোভার নাগরিকদের সচেতন সিদ্ধান্ত এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের অবিচল আস্থা দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করবে।