লন্ডনের ঐতিহাসিক ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ১০ রাতের এক অসাধারণ আবাসিক পর্বের পর, ব্রিটিশ রক ব্যান্ড কোল্ডপ্লে তাদের বিশ্বজুড়ে সমাদৃত "মিউজিক অফ দ্য স্ফিয়ারস" সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। ২২শে আগস্ট থেকে ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত বিস্তৃত এই কনসার্টগুলি ব্যান্ডের ২৫ বছরের দীর্ঘ এবং প্রভাবশালী কর্মজীবনের হিট গানগুলির এক বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা ও সঙ্গীতের প্রদর্শনী ছিল। এই অনুষ্ঠানগুলি কেবল সঙ্গীতপ্রেমীদেরই মুগ্ধ করেনি, বরং বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সাক্ষী করেছে, যা তাদের বিশ্বব্যাপী প্রভাবের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
গত আড়াই দশক ধরে, কোল্ডপ্লে কেবল একটি ব্যান্ড হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেনি, বরং বিশ্ব সঙ্গীতের মঞ্চে এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাদের "মিউজিক অফ দ্য স্ফিয়ারস" বিশ্ব সফর, যা ২০২২ সালে শুরু হয়েছিল, তা সর্বকালের সবচেয়ে বেশি দর্শক-অংশগ্রহণকারী সফর হিসেবে রেকর্ড গড়েছে, যেখানে ১২ মিলিয়নেরও বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোল্ডপ্লের এই দীর্ঘস্থায়ী আবেদন তাদের সঙ্গীতের গভীরতা, মঞ্চে তাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের বিবর্তনের ফলেই সম্ভব হয়েছে। যেখানে তাদের প্রথম দিকের কাজগুলি আরও অন্তর্মুখী ছিল, সময়ের সাথে সাথে তারা বৃহত্তর শ্রোতাদের জন্য আরও উদ্দীপক এবং বিশ্বজনীন সঙ্গীত তৈরি করেছে। তাদের প্রতিটি অ্যালবাম ইউকে চার্টে শীর্ষস্থান দখল করেছে, যা তাদের ধারাবাহিক জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
এই সফরটি কেবল বাণিজ্যিক সাফল্যই আনেনি, বরং পরিবেশগতভাবেও এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যেখানে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগগুলির মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে মঞ্চ তৈরি এবং প্রতিটি টিকিটের জন্য একটি করে গাছ লাগানো। ওয়েম্বলির এই কনসার্টগুলি কেবল গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল না, বরং এটি ছিল এক সম্মিলিত উৎসব যা দর্শকদের একাত্ম করে তোলে।
ব্যান্ডের সদস্যরা, বিশেষ করে ফ্রন্টম্যান ক্রিস মার্টিন, দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। কনসার্টে ব্যবহৃত এলইডি রিস্টব্যান্ডগুলি দর্শকদের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়েছে, যা পুরো স্টেডিয়ামকে এক আলোকসজ্জার সমুদ্রে পরিণত করে, যেখানে প্রতিটি দর্শকই যেন অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে। ক্রিস মার্টিন প্রায়শই দর্শকদের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতেন, কখনও ভক্তদের মঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলিকে সম্মান জানিয়ে, যা কনসার্টকে আরও অন্তরঙ্গ করে তোলে। একটি বিশেষ মুহূর্তে, ব্যান্ডটি হুইটনি হিউস্টনের "আই ওয়ানা ডান্স উইথ সামবডি" গানটি পরিবেশন করে, যা ক্রিস মার্টিন হাস্যরসাত্মকভাবে তার "ওয়ার্ম-আপ সং" বলে উল্লেখ করেন, যা দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল তোলে। এই ধরনের ঘটনাগুলি কনসার্টকে আরও স্মরণীয় করে তোলে এবং ভক্তদের সাথে ব্যান্ডের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে, যা তাদের শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, বরং মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবেও তুলে ধরে।
লন্ডনের পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘটের কারণে দুটি কনসার্ট পুনরায় নির্ধারিত হলেও, ব্যান্ডটি তাদের ভক্তদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা প্রদানে কোনো কমতি রাখেনি। ক্রিস মার্টিন ঘোষণা করেছেন যে প্রায় ১৮ মাস পর, অর্থাৎ ২০২৭ সালের দিকে, তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সফরের নতুন পর্যায় শুরু করার পরিকল্পনা করছেন, যা তাদের বিশ্বব্যাপী যাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আলো ও সঙ্গীতের মাধ্যমে একত্রিত করার এই ক্ষমতা কোল্ডপেকে এক অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। ওয়েম্বলিতে তাদের এই আবাসিক পর্বটি কেবল একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান ছিল না, বরং এটি ছিল তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী ঐক্যের এক শক্তিশালী বার্তা, যা আগামী প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীদেরও অনুপ্রাণিত করবে এবং দেখাবে কিভাবে সঙ্গীত সকল ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে এক সূত্রে বাঁধতে পারে।