২০২৫ সালের রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম. ইয়াহিয়াহকে, তাঁদের যুগান্তকারী ধাতব-জৈব কাঠামো বা মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs) নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ। এই তিন বিজ্ঞানী এমন আণবিক স্থাপত্যের জন্ম দিয়েছেন, যা রসায়ন জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্কগুলি হলো আণবিক বিন্যাস, যেখানে বিশাল আকারের ছিদ্র বা গহ্বর বিদ্যমান, যা গ্যাস ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ ধারণ ও নির্গমনে সক্ষম।
এই বৈপ্লবিক যাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে, যখন রিচার্ড রবসন তামা আয়নকে চার-বাহুবিশিষ্ট জৈব অণুর সাথে সংযুক্ত করে সুশৃঙ্খল, বিস্তৃত স্ফটিক তৈরি করেন। এই প্রাথমিক নকশাটি যদিও ভঙ্গুর ছিল এবং সহজেই ভেঙে যেত। তবে, ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে সুসুমু কিতাগাওয়া এবং ওমর এম. ইয়াহিয়াহ এই কাঠামোকে স্থিতিশীলতা প্রদানে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। কিতাগাওয়া প্রমাণ করেন যে গ্যাস এই কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করতে ও বেরিয়ে আসতে পারে, যা নকশা অনুযায়ী MOFs-কে নমনীয় ও পরিবর্তনযোগ্য করে তোলার সম্ভাবনা দেখায়। অন্যদিকে, ইয়াহিয়াহ ১৯৯৯ সালে অত্যন্ত স্থিতিশীল MOF-5 উপস্থাপন করেন, যা আল্ট্রা-হাই পোরোসিটি বা অতি-উচ্চ ছিদ্রতা প্রদর্শন করে এবং এটি ক্ষেত্রটির একটি ক্লাসিক উদাহরণে পরিণত হয়। এই পদার্থের কয়েক গ্রামেই একটি ফুটবল মাঠের সমান ক্ষেত্রফল লুকিয়ে থাকে, যা এটিকে গ্যাস শোষণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে।
এই আবিষ্কারগুলি রসায়নশাস্ত্রকে আণবিক স্তর থেকে স্থাপত্য স্তরে উন্নীত করেছে, যা রেটিকুলার রসায়ন নামক ধারণার জন্ম দিয়েছে। MOFs এখন পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। এই কাঠামো ব্যবহার করে মরুভূমির বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করা, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা এবং হাইড্রোজেন সঞ্চয় করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার পুরস্কারের অর্থ সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছে। নোবেল কমিটি ফর কেমিস্ট্রির চেয়ার হেইনার লিঙ্কে মন্তব্য করেছেন যে, ধাতব-জৈব ফ্রেমওয়ার্কগুলির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাস্টম-মেড উপকরণের জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনে দিয়েছে।
এই উপাদানগুলি কেবল পরিবেশ সুরক্ষাতেই নয়, বরং ঔষধ সরবরাহ, বিষাক্ত গ্যাস ধারণ, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করা এবং এমনকি জলের দূষণমুক্ত করার মতো ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, CALF-20 নামক একটি MOF কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের জন্য কানাডার একটি কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরস্কার প্রাপ্তির পর কিতাগাওয়া বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন যে তিনি ভাবছিলেন এত বড় পুরস্কার সত্যিই প্রাপ্য কিনা। রবসন তাঁর বয়স উল্লেখ করে বলেছিলেন যে পুরস্কারের পরবর্তী কোলাহল সামলানো কঠিন হবে। ইয়াহিয়াহ সরলভাবে জানিয়েছিলেন যে এমন মুহূর্তের জন্য কেউ প্রস্তুত থাকতে পারে না। এই আবিষ্কারগুলি দেখায় যে গভীর অনুসন্ধিৎসা এবং দীর্ঘমেয়াদী অধ্যবসায় কীভাবে মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণে অপরিহার্য সমাধান নিয়ে আসতে পারে, যা টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়নে এক দৃঢ় পদক্ষেপ।