ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA)-এর গাইয়া মহাকাশ টেলিস্কোপের ডেটা বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি বিশাল ঢেউয়ের সন্ধান পেয়েছেন। এই ঢেউটি, যা 'গ্রেট ওয়েভ' নামে পরিচিত, ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে সূর্যের চারপাশের কয়েক হাজার আলোকবর্ষ জুড়ে নক্ষত্রগুলির গতিবিধিকে প্রভাবিত করছে। ইতালির ইন্নাসিওনাল ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (INAF)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী এলোয়িসা পোগিও এই দলটি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে এই ঢেউয়ের ত্রিমাত্রিক চিত্র এবং নক্ষত্রের গতিবিধিতে এর ঢেউ-সদৃশ আচরণ বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। পোগিও এই ঢেউকে একটি স্টেডিয়াম ওয়েভের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে গ্যালাক্সির সময়কাল অনেক দীর্ঘ হলেও, পর্যবেক্ষণ করা ঘটনাটি যেন সময়ের মধ্যে স্থির হয়ে থাকা একটি স্টেডিয়াম ওয়েভের মতো।
তরুণ খোলা নক্ষত্র এবং সেফেইড ভেরিয়েবল নক্ষত্রগুলির অবস্থান ও গতিবিধি অধ্যয়ন করে বিজ্ঞানীরা এই বিস্ময়কর ঢেউটি সনাক্ত করেছেন। গবেষকরা মনে করছেন যে গ্যালাক্সির চাকতির গ্যাসও এই বিশাল ঢেউয়ের অংশীদার, কারণ এই তরুণ নক্ষত্র এবং সেফেইডগুলি এর সাথে সাথে চলছে। এই মহাজাগতিক আলোড়নের সঠিক উৎস এখনও অজানা। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে একটি বামন গ্যালাক্সির সাথে সংঘর্ষ, যেমন ধনু বামন গ্যালাক্সি, এর কারণ হতে পারে, তবে এই তত্ত্ব নিশ্চিত করার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
এই 'গ্রেট ওয়েভ'টি সূর্যের থেকে ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে আবিষ্কৃত ছোট ঢেউ, যা 'র্যাডক্লিফ ওয়েভ' নামে পরিচিত, তার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। এই ঢেউটি ৯,০০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। পোগিও স্পষ্ট করেছেন যে র্যাডক্লিফ ওয়েভটি অনেক ছোট এবং বর্তমান ঢেউয়ের তুলনায় ছায়াপথের চাকতির ভিন্ন অংশে অবস্থিত। গাইয়া টেলিস্কোপ, যা ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং যার থেকে ভবিষ্যতে, ডিসেম্বর ২০২৬-এ, আরও ডেটা প্রকাশের আশা করা হচ্ছে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দুই বিলিয়ন নক্ষত্র এবং অন্যান্য বস্তুর তিন ট্রিলিয়নেরও বেশি পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মাধ্যমে নক্ষত্রগুলির গতিবিধি, উজ্জ্বলতা, তাপমাত্রা এবং গঠন বিশ্লেষণ করে একটি নির্ভুল ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে।
এই ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন যে গ্যালাক্সিটি স্থির নয়, বরং এটি একটি বিশাল ঢেউয়ের মতো আচরণ করছে যা কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ঢেউটি প্রায় ৩২,৬০০ থেকে ৬৫,২০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং নক্ষত্রগুলির গতিবিধিতে একটি তরঙ্গায়িত প্রভাব ফেলছে। গবেষকরা মনে করছেন যে এই ধরনের মহাজাগতিক আলোড়নগুলি নতুন নক্ষত্র গঠন এবং ছায়াপথের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই 'গ্রেট ওয়েভ' এবং 'র্যাডক্লিফ ওয়েভ'-এর মতো ঘটনাগুলি মহাবিশ্বের জটিলতা এবং গতিশীলতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও প্রসারিত করবে। বিজ্ঞানীরা এই মহাজাগতিক ঢেউগুলির উৎস এবং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গঠন ও বিবর্তনের উপর তাদের প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন।