লাল বামন তারা থেকে প্রথমবার ভর নির্গমন শনাক্ত করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, সৌরজগতের বাইরে মহাজাগতিক আবহাওয়ার প্রমাণ

সম্পাদনা করেছেন: Uliana S.

ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো সৌরজগতের বাইরে অবস্থিত একটি তারা থেকে সরাসরি করোনাল মাস ইজেকশন (CME) বা ভর নির্গমনের প্রমাণ পেয়েছেন। এই যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটেছে পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি লাল বামন তারায়। এই আবিষ্কার বহিঃসৌর মহাজাগতিক আবহাওয়া (extrasolar space weather) সংক্রান্ত গবেষণাটিকে নিছক তাত্ত্বিক অনুমান থেকে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষামূলক প্রমাণের ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে। এই পর্যবেক্ষণটি সফল করতে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA)-এর এক্সএমএম-নিউটন (XMM-Newton) মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং ভূমি-ভিত্তিক রেডিও টেলিস্কোপ লোফার (LOFAR)-এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

করোনাল মাস ইজেকশন হলো উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন প্লাজমা এবং বিকিরণের একটি বিশাল বিস্ফোরণ, যা কাছাকাছি গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে সক্ষম। এই পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলি বিখ্যাত 'নেচার' (Nature) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা অন্যান্য তারার কার্যকলাপ নিয়ে বহু বছরের গবেষণার চূড়ান্ত ফল। নথিভুক্ত এই পদার্থটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটছিল, যা সূর্য থেকে রেকর্ড করা বিশটি সৌর শিখার মধ্যে একটির গতির সমতুল্য। যদিও সূর্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিস্ফোরণ একটি সাধারণ ঘটনা, কিন্তু অন্য কোনো তারায় এর সরাসরি শনাক্তকরণ এত দিন অধরা ছিল।

এই ঘটনার নির্ভরযোগ্য সূচক ছিল টাইপ II রেডিও বার্স্ট—একটি তীব্র, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী সংকেত। যখন প্লাজমা তারার বাইরের স্তর ভেদ করে বেরিয়ে আসে, তখন সৃষ্ট শক ওয়েভ বা অভিঘাত তরঙ্গ এই সংকেত তৈরি করে। নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি (ASTRON)-এর জোসেফ ক্যালিংহাম জোর দিয়ে বলেছেন যে, পূর্ববর্তী তথ্যগুলি কেবল সিএমই-এর ইঙ্গিত দিলেও, তারাটি যে আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে তার পদার্থ হারাচ্ছে, তার প্রমাণ দিতে পারেনি। লাল বামন তারাগুলি হলো আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সবচেয়ে সাধারণ প্রকারের তারা, এবং অধিকাংশ পরিচিত বহিঃগ্রহ (exoplanets) এই ধরনের তারাকেই প্রদক্ষিণ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে এই লাল বামন তারাগুলি সূর্যের চেয়ে ছোট এবং অনুজ্জ্বল হলেও, এদের চৌম্বক ক্ষেত্র অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলস্বরূপ, এদের মহাজাগতিক আবহাওয়াও অনেক বেশি চরম হয়। নেদারল্যান্ডসের ইএসটিইসি (ESTEC)-এর গবেষক হেনরিক একলুন্ড মন্তব্য করেছেন যে এই কাজটি নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ অধ্যয়নের জন্য একটি নতুন পর্যবেক্ষণমূলক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ছোট তারার চারপাশে মহাজাগতিক আবহাওয়ার তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে, যা তাদের প্রদক্ষিণকারী গ্রহগুলির সম্ভাব্য বাসযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই আবিষ্কার জ্যোতির্জীববিদ্যা (astrobiology) এবং গ্রহমণ্ডলের বিবর্তনের বোঝার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এত শক্তিশালী একটি ভর নির্গমন লাল বামন তারার কাছাকাছি থাকা যেকোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষয় করে দিতে পারে, এমনকি যদি সেই গ্রহটি তথাকথিত “বাসযোগ্য অঞ্চলে” (habitable zone) অবস্থিত থাকে। এটি সম্ভাব্য বাসযোগ্য জগতে বায়ুমণ্ডলের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

এই পর্যবেক্ষণ সফল হয়েছে প্রযুক্তির সমন্বয়ের কারণে: এক্স-রে টেলিস্কোপ এক্সএমএম-নিউটন তারাটির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে, আর ২০,০০০ অ্যান্টেনার নেটওয়ার্ক লোফার (LOFAR) অভিঘাত তরঙ্গের ফলে সৃষ্ট রেডিও সংকেতটি শনাক্ত করেছে। এইভাবে, বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় পরীক্ষামূলক তথ্য পেয়েছে যা নিশ্চিত করে যে সক্রিয় লাল বামন তারার চারপাশের গ্রহগুলির জন্য বায়ুমণ্ডল ধরে রাখা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে মহাকাশের আবহাওয়া কেবল আমাদের সৌরজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মহাবিশ্বের অন্যান্য অংশেও গ্রহের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উৎসসমূহ

  • euronews

  • Euronews

আপনি কি কোনো ত্রুটি বা অসঠিকতা খুঁজে পেয়েছেন?

আমরা আপনার মন্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করব।