তুরস্কের আনতালিয়া প্রদেশের কাş জেলার উপকূলবর্তী জলসীমায় এক যুগান্তকারী প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে সাড়ে এগারো শতকের (প্রায় ১,১০০ বছর) প্রাচীন কাঁচের সুগন্ধি বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। আকদেনিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস অনুষদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডঃ হাকান ওনিজের নেতৃত্বে পরিচালিত জলতল প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি বাণিজ্য জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই অমূল্য নিদর্শনগুলো পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার কেবল প্রাচীন সুগন্ধি শিল্পেরই নয়, বরং সেই সময়ের উন্নত কাঁচ তৈরির কৌশল এবং বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্কেরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মোট পনেরোটি কাঁচের সুগন্ধি বোতল প্রথমবার জনসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হয়। এই প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রত্নতত্ত্ব সিম্পোজিয়াম এবং প্রত্নতত্ত্বের স্বর্ণযুগ প্রদর্শনীতে, যেখানে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান এই অনুষ্ঠানে বলেন যে, তুরস্ক স্থল ও জল উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের দিক থেকে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ২০০২ সাল থেকে তুরস্ক ১৩,২৯১টি ঐতিহাসিক নিদর্শন দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এই ধরনের উদ্যোগ তুরস্কের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতাকে প্রমাণ করে।
সহযোগী অধ্যাপক ডঃ ওনিজ, যিনি জলতল প্রত্নতত্ত্বের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং এই ক্ষেত্রে তুরস্কের অগ্রণী ভূমিকার অন্যতম কারিগর, তিনি এই আবিষ্কারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, এই বোতলগুলি প্রায় ৬-৭ সেন্টিমিটার উচ্চতার এবং এগুলিতে সম্ভবত গোলাপ তেল, কস্তুরী বা অ্যাম্বারের মতো অত্যন্ত মূল্যবান সুগন্ধি দ্রব্য সংরক্ষণ করা হত। এই সুগন্ধিগুলি আব্বাসীয় যুগে (আনুমানিক ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দী) লেভান্ট এবং মিশর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত ও বাণিজ্য হত। বোতলগুলি সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মোল্ড-ব্লোয়িং কৌশলে তৈরি করা হয়েছিল, যা সেই সময়ের কাঁচ তৈরির উন্নত প্রযুক্তির সাক্ষ্য বহন করে। এই আবিষ্কারগুলি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীন বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের কেন্দ্রিকতাকে পুনরায় প্রমাণ করে, যেখানে কাঁচ ও সুগন্ধি প্রযুক্তি পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তুরস্কের জলতল প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব কেবল এই আবিষ্কারেই সীমাবদ্ধ নয়। আকদেনিজ বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সাল থেকে ৪১১টি জাহাজডুবি স্থান আবিষ্কার করেছে, যার মধ্যে ৩৬০০ বছরের পুরানো কুমলুকা মধ্য ব্রোঞ্জ যুগের জাহাজডুবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা বিশ্বের প্রাচীনতম আবিষ্কৃত বাণিজ্য জাহাজের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পরিচিত। এই ধরনের ধারাবাহিক এবং গভীর খননকার্য তুরস্কের জলসীমার নিচে লুকিয়ে থাকা অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আনাতোলিয়ার ভূমি প্রাচীনকাল থেকেই কাঁচ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ৩৫০০ বছরেরও বেশি পুরানো কাঁচের নমুনার আবিষ্কারে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানগুলি কেবল অতীতের বস্তুগত অবশেষই নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতা, জ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান এবং মানুষের নান্দনিকতার প্রতি চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার এক প্রতিচ্ছবি। এই আবিষ্কারগুলি আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা, তাদের বাণিজ্য নেটওয়ার্ক এবং তারা কীভাবে বিশ্বকে সংযুক্ত করেছিল সে সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রচেষ্টাগুলি তুরস্কের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে, যা মানবজাতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতার এক মূল্যবান অংশ।