জুলাই ২০২৫-এ, ফেন্ডৌজহে নামক অত্যাধুনিক সাবমার্সিবল ব্যবহার করে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কুরিলে-কামচাটকা এবং আলেউটিয়ান ট্রেঞ্চে এক যুগান্তকারী অভিযান সম্পন্ন করেছে। প্রায় ৪০ দিন ধরে চলা এই অভিযানে, তারা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯,৫৩৩ মিটার (৩১,২৭৬ ফুট) গভীরতায় এমন এক প্রাণবন্ত বাস্তুতন্ত্রের সন্ধান পেয়েছে, যা জীবনের চরম সহনশীলতা এবং অভিযোজন ক্ষমতার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ। এই আবিষ্কার, যা প্রকৃতির অসীম সম্ভাবনাকে তুলে ধরে, জীবনের টিকে থাকার জন্য প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
এই গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রগুলি সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল নয়, যা পৃথিবীর বেশিরভাগ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবর্তে, তারা কেমোসিন্থেসিস (chemosynthesis) নামক এক ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি আহরণ করে। সমুদ্রের তলদেশে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেখানে বসবাসকারী অণুজীব, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়া, সমুদ্রের তলদেশ থেকে নিঃসৃত মিথেন (methane) এবং হাইড্রোজেন সালফাইড (hydrogen sulfide)-এর মতো রাসায়নিক পদার্থগুলিকে ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে। এই রাসায়নিক শক্তিই এই বাস্তুতন্ত্রের প্রাণীদের খাদ্যের প্রধান উৎস, যা এক সম্পূর্ণ নতুন খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি করেছে। এই বিস্ময়কর জীবনযাত্রা সমুদ্রের 'হেডাল জোন' (hadal zone)-এ সংঘটিত হয়েছে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর এবং কম অন্বেষিত অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানে চাপ পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় হাজার হাজার গুণ বেশি, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি এবং আলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এমন প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত এবং অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন। এই আবিষ্কার প্রকৃতির অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং প্রতিকূলতাকে জয় করে নতুনভাবে গড়ে ওঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এই গভীর বাস্তুতন্ত্রগুলিতে প্রধানত টিউব ওয়ার্ম (tube worms) এবং ক্ল্যাম (clams) বা ঝিনুক জাতীয় প্রাণীদের আধিক্য দেখা গেছে। এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি হয়তো সম্পূর্ণ অজানা এবং এদের সহাবস্থান (symbiotic relationship) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রাণীদের দেহে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি রাসায়নিক পদার্থ থেকে শক্তি তৈরি করে যা তাদের পুষ্টি জোগায়, যা জীবনের আন্তঃসংযোগের এক গভীর দৃষ্টান্ত। এই আবিষ্কার কেবল পৃথিবীর গভীরতম জীবনের রহস্য উন্মোচন করেনি, বরং মহাকাশ গবেষণার জন্যও নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যেহেতু মিথেন এবং হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থ মহাকাশেও বিদ্যমান, তাই বৃহস্পতি ও শনির চাঁদগুলির মতো অন্যান্য গ্রহেও অনুরূপ জীবনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই গবেষণা জীবনের উৎপত্তি এবং চরম পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়াকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
গবেষণার সহ-লেখক, ইনস্টিটিউট অফ ডিপ সি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সামুদ্রিক ভূ-রসায়নবিদ মেংরান ডু (Mengran Du) বলেছেন, "আমাদের আবিষ্কারের বিশেষত্ব কেবল এর গভীরতাই নয়, বরং আমরা যে কেমোসিন্থেটিক জীবনের প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্য দেখেছি, তা সত্যিই বিস্ময়কর।" এই আবিষ্কার জীবনের সীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রসারিত করেছে এবং ভবিষ্যতে এই গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের বিপাকীয় অভিযোজন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে খাদ্য আহরণের পদ্ধতিগুলি বোঝার জন্য নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের এই গভীরতম প্রান্তে আবিষ্কৃত রাসায়নিক-নির্ভর বাস্তুতন্ত্র প্রমাণ করে যে, জীবন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অবিশ্বাস্যভাবে সৃজনশীল এবং অভিযোজনশীল। এই আবিষ্কার প্রকৃতির অসীম ক্ষমতা এবং মহাবিশ্বে জীবনের সম্ভাবনার এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে, যা আমাদের চারপাশের জগতকে আরও গভীর উপলব্ধির সাথে দেখতে অনুপ্রাণিত করে।