পেরুর উত্তরাঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেনিকো নামক এক প্রাচীন শহর আবিষ্কার করেছেন, যা আন্দিজ সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের উপর আলোকপাত করেছে। রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পেনিকো শহরটি আনুমানিক ১৮০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার বয়স ৩,৮০০ বছরেরও বেশি। এই আবিষ্কার পেরুর প্রাচীনতম সভ্যতা, যেমন কারা'ল, যা প্রায় ৫,০০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। পেনিকো শহরটিতে ১৮টি কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় মন্দির এবং আবাসিক ভবন। এটি একটি উন্নত ও সুসংগঠিত সমাজের ইঙ্গিত দেয়।
এখানকার একটি প্রধান জনসমাগমের ভবন, যা বি২ বা পুটুসের আনুষ্ঠানিক হল নামে পরিচিত, সেখানে পুটুস (pututus) অর্থাৎ প্রাচীন আন্দিজীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত শঙ্খের নকশা ও কারুকার্য দেখা যায়। পুটুস কেবল একটি বাদ্যযন্ত্রই ছিল না, এটি ছিল আন্দিজীয় সংস্কৃতিতে যোগাযোগ, ধর্মীয় আচার এবং যুদ্ধের সংকেত প্রেরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই শঙ্খের ধ্বনি হাজার হাজার বছর ধরে আন্দিজ পর্বতমালায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে এবং এটি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক গভীর বন্ধনের প্রতীক। কারা'ল সভ্যতার পতনের পর, প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, পেনিকো শহরটি আন্দিজীয় সমাজের স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার এক মূল্যবান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এখানে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু যেমন হাতে তৈরি মাটির মূর্তি, শামুক-ঝিনুকের মালা, রোডোক্রোসাইট (rhodochrosite) ও ক্রাইসোকোলা (chrysocolla) নামক রত্নপাথর এবং পশুর হাড় একটি সুসংগঠিত সমাজ ও বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্কের প্রমাণ দেয়। বানরের মূর্তিগুলির আবিষ্কার আমাজন অঞ্চলের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে তাদের জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের পরিধিকে প্রসারিত করে। রোডোক্রোসাইট এবং ক্রাইসোকোলা-র মতো রত্নপাথরগুলি প্রাচীনকালে সোনা গলানোর কাজে ব্যবহৃত হত এবং এগুলি সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ মিটার উচ্চতায়, সুপে নদীর কাছে পেনিকোর কৌশলগত অবস্থান সম্ভবত বন্যা ও ভূমিধস থেকে সুরক্ষা দিত এবং বাণিজ্যকে সহজতর করত। এটি পেরুর উপকূল, আন্দিজের পার্বত্য অঞ্চল এবং আমাজন অববাহিকার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করেছিল, যা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদানকে উৎসাহিত করেছিল। এই শহরটি প্রায় ৮ বছর ধরে খনন ও পুনরুদ্ধারের পর, প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ রুথ শ্যাডি-র (Dr. Ruth Shady) নেতৃত্বে গত ১২ জুলাই, ২০২৫ তারিখে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক শিল্পীরা পুটুস বাজিয়ে পচামামা (Pachamama) অর্থাৎ ধরিত্রী মাতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, যেখানে কৃষিপণ্য, কোকা পাতা এবং স্থানীয় পানীয় উৎসর্গ করা হয়েছিল। পেনিকো-র এই আবিষ্কার কেবল পেরুর প্রাচীন ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং এটি আধুনিক সমাজকেও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং টেকসই জীবনযাপনের মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে। দর্শনার্থীরা এখন পেনিকোর সংরক্ষিত ধ্বংসাবশেষ, ধর্মীয় ভবন, আবাসিক এলাকা এবং প্লাজাগুলি ঘুরে দেখতে পারেন। একটি আধুনিক ব্যাখ্যা কেন্দ্র ডিজিটাল পুনর্গঠনের মাধ্যমে শহরটির অতীতের জাঁকজমক কল্পনা করতে সাহায্য করে, যা প্রাক-কলম্বিয়ান পেরুর বোঝাপড়াকে আরও গভীর করে।