ফিনল্যান্ডের টুর্কু বিশ্ববিদ্যালয় (University of Turku) পরিচালিত একটি নতুন গবেষণা অনুসারে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে, বিশেষ করে বনাঞ্চলে সময় কাটানো মানুষের সামগ্রিক সুস্থতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এই সুস্থতা কেবল ক্ষণস্থায়ী আনন্দ নয়, বরং জীবনের উদ্দেশ্য, আত্ম-গ্রহণযোগ্যতা, ব্যক্তিগত বিকাশ এবং ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপন সহ ইউডাইমোনিক সুস্থতা (eudaimonic well-being) নামে পরিচিত গভীরতর অনুভূতিগুলোর সাথে জড়িত।
গবেষণায় ১৫৮ জন অংশগ্রহণকারী, যাদের মধ্যে তরুণ ও বয়স্ক উভয়ই ছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে তারা নিজেদের মূল্যবোধ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন এবং আত্ম-গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন তাদের নিজেদের, অন্যদের এবং বৃহত্তর পৃথিবীর সাথে এক গভীর বন্ধন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। ডক্টরাল গবেষক জোহা জারিক্যারি (Joha Järekari) উল্লেখ করেছেন যে, প্রকৃতি মানুষকে জীবনের অগ্রাধিকারগুলি চিহ্নিত করতে এবং ব্যক্তিগত বিকাশে সহায়তা করে। এই গবেষণাটি প্রকৃতি-ভিত্তিক পর্যটনে সহ-নকশার (co-design) গুরুত্বের উপরও জোর দিয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য গভীর ব্যক্তিগত রূপান্তরে সহায়তা করতে পারে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, প্রকৃতির সান্নিধ্য কেবল মানসিক চাপ কমায় না, বরং জীবনের গভীরতর অর্থ খুঁজে পেতেও সাহায্য করে। ফিনল্যান্ডের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ইনস্টিটিউট (THL) এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ইনস্টিটিউট (Luke) এর একটি যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, যেমন শহুরে বন এবং সবুজ স্থান, হতাশা ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই সমীক্ষা আরও জানিয়েছে যে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্য অত্যন্ত উপকারী; এটি হতাশা থেকে রক্ষা করে, মানসিক চাপ কমায় এবং মেজাজ উন্নত করে। ফিনল্যান্ডে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির কারণে বার্ষিক প্রায় ১১ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় হয়, তাই প্রকৃতির এই উপকারিতাগুলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
গবেষণাটি আরও দেখায় যে, প্রকৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়া মানুষের আত্ম-গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায় এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তরুণ এবং বয়স্ক উভয় অংশগ্রহণকারীই প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক ধরণের বিচারহীনতা অনুভব করেছেন, যা তাদের আত্ম-গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। জোহা জারিক্যারি আরও বলেন, “প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো অংশগ্রহণকারীদের জীবনে যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তা সামনে নিয়ে আসে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস এবং স্বায়ত্তশাসন বাড়ায়।”
প্রকৃতি-ভিত্তিক পর্যটনের ক্ষেত্রে সহ-নকশার (co-design) ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পর্যটকদের চাহিদা এবং প্রত্যাশা পূরণের জন্য পরিষেবাগুলি তৈরি করতে সাহায্য করে। ফিনল্যান্ডের ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় (University of Eastern Finland) এর একটি গবেষণা অনুসারে, পর্যটন অভিজ্ঞতাগুলি গ্রাহক এবং পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যে সহযোগিতামূলকভাবে তৈরি করা উচিত। এটি নিশ্চিত করে যে অভিজ্ঞতাগুলি ব্যবহারকারীদের গভীর ব্যক্তিগত রূপান্তরের জন্য অর্থপূর্ণ এবং গ্রাহক-কেন্দ্রিক।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, বনাঞ্চলে সময় কাটানো মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। জাপানি গবেষণা 'শিনরিন-ইয়োকু' (Shinrin-yoku) বা 'বন স্নান' (forest bathing) এর মতো ধারণাগুলি এই উপকারিতাগুলিকে তুলে ধরে। বনাঞ্চল থেকে নির্গত ফাইটনসাইড (phytoncides) নামক উদ্বায়ী জৈব যৌগগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, মানসিক চাপ কমাতে এবং সামগ্রিক সুস্থতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এমনকি শহুরে পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য সবুজের সান্নিধ্যও মানুষের মেজাজ উন্নত করতে এবং মনোযোগ বাড়াতে পারে। এই গবেষণাগুলি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন কেবল একটি স্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা নয়, বরং এটি গভীর ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সুস্থ জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ।